আমায় ক্ষমো হে-আন্ডার-ইনভয়েসিং, ওভার-ইনভয়েসিং ও বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম by মামুন রশীদ

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য ও পণ্য বাণিজ্য নিয়ে সব সময়ই কিছু না কিছু রাজনীতি হয়েছে। আমরা যখন স্থানীয়ভাবে কোনো পণ্য উৎপাদন করি, তখন সচরাচর শুনতে পাই, উৎপাদকরা তাঁদের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের সঠিক বা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। তাঁরা যে দামে পণ্য বিক্রি করেন তার চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি।


কিংবা পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদয় লাভের অঙ্কটা পাইকারি ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী ও খুচরা বিক্রেতাদের পকেটে চলে যায়। আবার যখন এসব পণ্যসামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি হয় তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে একধরনের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে তাঁরা কম দামে আমদানি করা নিম্নমানের পণ্যেরও অনেক উচ্চ দাম হাঁকান। শুধু তা-ই নয়, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা অহরহ কর ফাঁকি দেন; এমনকি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে বাজারে পণ্যের জোতদারি তথা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করেন। এভাবে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বিপুল অঙ্কের মুনাফা হাতিয়ে নেন।
আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার-ইনভয়েসিং (চালানপত্রে পণ্যের দাম কম দেখানো) ও ওভার-ইনভয়েসিংয়ের (চালানপত্রে পণ্যের দাম বেশি দেখানো) অভিযোগ রয়েছে। অতীতে আমরা প্রায়ই 'আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের' অভিযোগ শুনতাম। আজকাল অবশ্য ওভার-ইনভয়েসিংয়ের অভিযোগই বেশি শোনা যায়। সাধারণত কোনো পণ্যের আমদানি শুল্কহার বেশি হলে চালানপত্রে পণ্যের দাম কম দেখানো হয়, যাতে কম পরিমাণ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্যই এমনটি করা হয়। রপ্তানি ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণ শুল্ক পরিশোধ এড়াতে আন্ডার-ইনভয়েসিং করা হয়। অন্যদিকে আমদানির ক্ষেত্রে ওভার-ইনভয়েসিং করা হয় পণ্যের যে দাম পরিশোধ করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি দাম দেখানোর মাধ্যমে। শুল্ক হার কমিয়ে বেশি মুনাফা করতেই ইনভয়েসিং সাধারণত ওভার করা হয়। অতীতে শুল্ক বা কর হার উচ্চ থাকায় আমদানিকারকদের মধ্যে আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পণ্যের দাম কম দেখানোর একটি সাধারণ প্রবণতা বেশ লক্ষণীয় ছিল। অনানুষ্ঠানিক বা অবৈধ চ্যানেলে পণ্যের প্রকৃত দামের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো কর ফাঁকির একটি অংশ। দেশে অব্যাহতভাবে শুল্ক উদারীকরণ ও সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার ফলে আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের প্রবণতা কমে এসেছে। তবে ওভার-ইনভয়েসিংয়ের প্রবণতা ইদানীং বেড়েছে। এটি বিভিন্ন কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। কারণগুলো হচ্ছে : ১. বিদেশে মূল্যবান মুদ্রায় (হার্ড কারেন্সি) অর্থ গচ্ছিত রাখা, যা দিয়ে বিদেশে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি সম্পদ ক্রয় ও ২০০৭-০৮ সালের মতো 'দুর্দিনে' পড়লে কাজে লাগানো যায়। ২. প্রধান মুদ্রাগুলোর বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার দাম অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ায় টাকার মানের এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া বা মোকাবিলা করা। ৩. আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্যও বাড়তি দাম পরিশোধের কাজে লাগানো। যেমন- একই কম্পানি খাদ্যপণ্য ও সিমেন্টের মতো দুটি ব্যবসায়ে নিয়োজিত থাকলে এমনটি ঘটতে পারে। কারণ খাদ্যপণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়; কিন্তু সিমেন্ট তৈরির উপাদান ক্লিংকার আমদানিতে তুলনামূলক উচ্চহারে শুল্ক আরোপিত রয়েছে। সে জন্য তারা সিমেন্ট আমদানিতে আন্ডার-ইনভয়েস এবং খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ওভার-ইনভয়েসিংয়ের আশ্রয় নিতে পারে। যাতে খাদ্যের জন্য অতিরিক্ত যে অর্থ বিদেশে নেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে সিমেন্ট তথা ক্লিংকার আমদানির বিল পরিশোধ করা যায়।
পণ্য ব্যবসায়ী বা আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে সাম্প্র্রতিককালে একটি জোরালো অভিযোগ উঠেছে যে তারা পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাপকহারে ওভার-ইনভয়েসিং করে থাকেন। ফলে স্থানীয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং পরিণতিতে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ওভার-ইনভয়েসিংয়ের কারণে আমদানির নামে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে যেসব আমদানিকারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাদের কঠোর হাতে দমন করাটা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য বেশ কঠিন বৈকি। তবে আমদানিকারকরা যেহেতু ব্যাংক খাতের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন নিষ্পত্তি করেন, সেহেতু ব্যাংকগুলোকে সব সময়ই এ ব্যাপারে কড়া চাপের মধ্যে রাখা হয়। নিয়ন্ত্রক মহলের ধারণা, এতে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা পরোক্ষভাবে একটি বার্তা পেয়ে যাবেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সাধারণত আমদানিনীতিই অনুসরণ করে থাকে। যেখানে বলা হয়েছে, লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খোলার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেই পণ্যের দাম যাচাই করে দেখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক বিনিময়সংক্রান্ত গাইডলাইন বা নির্দেশনাতেও ঠিক একই ধরনের কথা বলা আছে।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংককে তিরস্কার বা সতর্ক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যমে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়তো আরো কিছু করার কথা ভাবছে। গেল কয়েক বছর আমরা অনেক আমদানিকারকের মধ্যেই 'ফিউচার মার্কেট' থেকে পণ্যসামগ্রী কেনার প্রবণতা লক্ষ করেছি। এই প্রবণতা বেশি দেখা যায় ২০০৮ সালে। ওই সময় আমদানিকারকরা ফিউচার মার্কেট থেকে ভোজ্য তেল, চিনি ও স্টিল মিলের কাঁচামাল বা উপকরণ হট রোলড্ কয়েল ইত্যাদি কিনেছিলেন। যাতে পণ্যবাজারে দাম বেড়ে যাওয়াটা এড়ানো যায়। বিশেষ করে বড় আমদানিকারকরাই এ ধরনের কাজ করেছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা পরবর্তী কোনো তারিখে লেটার অব ক্রেডিট বা এলসি (আমদানি ঋণপত্র) খুলেছিলেন। এভাবেই ফিউচার মার্কেট থেকে পণ্য কিনে আমদানিকারকরা তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। কিন্তু ২০০৯ সালের দিকে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে, তখন বেশির ভাগ আমদানিকারকের হাত পুড়তে শুরু করে। অর্থাৎ ফিউচার মার্কেট থেকে কেনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা ধরা খেয়ে বসেন। এ অবস্থায় আমদানিকারকদের আমরা ব্যাংকের নির্বাহীদের শরণাপন্ন হয়ে আক্ষেপ-আহাজারি করতে দেখেছি। তখন ব্যাংকভেদে ভোজ্য তেল ও স্টিল মিলের পণ্য আমদানিকারকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে বা ঋণের দায় বাড়াতে কিংবা নিজেদের আয়ের ওপরই আঘাত মেনে নিতে দেখা গেছে। এ মুহূর্তে চট্টগ্রামের একজন আমদানিকারকের কথা মনে পড়ছে। তখন ওই আমদানিকারকের জন্য ফিউচার মার্কেট থেকে পণ্য কেনার কৌশল বিপদই ডেকে এনেছিল। কারণ তাঁরা যখন বুকিং দিয়েছিলেন, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম ছিল এক হাজার ২০০ মার্কিন ডলার, আর যখন এলসি বা আমদানি ঋণপত্র খোলেন বা চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভোজ্য তেল পৌঁছায় তত দিনে দাম কমে প্রায় অর্ধেকে, অর্থাৎ ৬০০ ডলারে নেমে আসে। এতে কম্পানিটিকে বিপুল অঙ্কের অর্থ খেসারত দিতে হয়েছিল। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে একটি স্টিল মিলের মালিকের বেলায়ও। ওই কম্পানির আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দেওয়া ও এলসি বা আমদানি ঋণপত্র খোলার সময় বা এলসি নিষ্পত্তিকালে পণ্যের দামে পার্থক্য দাঁড়ায় প্রায় ১০০ শতাংশ। এভাবে ফিউচার মার্কেটে পণ্য কিনতে গিয়ে বেশির ভাগ আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আবার কেউ কেউ তো রীতিমতো দেউলিয়া হওয়ার দশায় পড়ে গিয়েছিলেন। সেই যাত্রায় শুধু তাঁরাই টিকে বা উতরে গিয়েছিলেন, যাঁদের পকেটের গভীরতা ছিল অনেক বেশি। নিচের সারণিতে দেখা যায় যে ক্রুড সয়াবিন বা অপরিশোধিত সয়াবিন তেল (সিডিএসও), ক্রুড পামঅয়েল বা অপরিশোধিত পামতেল (সিপিও) ও হট রোলড্ কয়েলের (এইচআর কয়েল) দাম ব্যাপক হারে ওঠানামা করেছিল।
বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দাম
আমরা অতীতে এমনও দেখেছি যে কোনো কোনো বিদেশি বিক্রেতা তাদের পণ্যের বিপরীতে অস্বাভাবিক বা ভুতুড়ে কিংবা রহস্যময় দাম হাঁকিয়ে বাংলাদেশের নতুন বা উদীয়মান আমদানিকারকদের আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের আমদানিকারকরা যখন আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, জাপান ও কোরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে পণ্য আমদানি করছেন তখন চীন ও ভারতের কিছু রপ্তানিকারক 'বাজারবহির্ভূত দাম' বা 'আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন দাম' বা 'বেপরোয়া কোনো দাম' হেঁকে ছোটখাটো বা বাদবাকি আমদানিকারককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, যারা কার্গোযোগে কম পরিমাণ পণ্য আনে। দেশের বড় বড় আমদানিকারকও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দেশের এ ধরনের অখ্যাত-অজ্ঞাত রপ্তানিকারকদের প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন।
এ কথা সত্য যে বাংলাদেশের পণ্যবাজার হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাতেই রয়ে গেছে। এসব অপারেটর ইচ্ছা করলে 'রপ্তানি আদেশ পাওয়া', 'সময়মতো পণ্য ডেলিভারি করা', 'প্রতিযোগিতামূলক দাম নিশ্চিতকরণ', 'সাপ্লাই চেইন বা বিতরণব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ' প্রভৃতি কাজ সম্পন্ন করতে পারে। ক্ষুদ্র অপারেটর বা আমদানিকারকরা বাজারের ওপর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কারণ সব ক্ষেত্রেই তাদের ব্যয়ের অঙ্কটা (পণ্য ক্রয়, ব্যাংক ঋণের সুদ, জাহাজ ভাড়া, বিতরণ বা সরবরাহের খরচ, গুদাম ভাড়া, বীমা ব্যয় ইত্যাদি) তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
তাহলে আমরা কী করব? আমরা কিভাবে বড় বড় আমদানিকারকের ব্যবসায়িক আচরণ ভালো করব? এ ক্ষেত্রে সব সময়ই ব্যাংক, কাস্টমস বা শুল্ক বিভাগ, প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শন কম্পানিসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে এ-সংক্রান্ত কার্যক্রমের ওপর নিবিড় নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ বজায় রাখতে হবে। এ কাজ করতে হলে আমাদের অবশ্যই আমদানিবিষয়ক প্রতিটি লেনদেন, একই রকম বা পরিমাণ পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের দাম, পণ্যের পরিমাণ ও গ্রাহক সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্যাবলির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তিগত সমাধান ও উৎকর্ষের এই যুগে এসব তথ্য পাওয়া বা জানা খুবই সহজ ও অনায়াসসাধ্য। তবে এসব কাজ করার সময় কেউই যেন কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হয়, সেটি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ঘনবসতিপূর্ণ, দুর্বল শাসন ও বিকাশমান বাণিজ্যের এই দেশে নিত্যপণ্যের 'সাপ্লাই চেইন' বা 'বিতরণব্যবস্থা' নির্বিঘ্ন রাখাটাও অত্যাবশ্যকীয়।

লেখক : ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.