স্মৃতিতে উজ্জ্বল সেই মুখ by নাসির আহমেদ

শামছুর রহমান কেবল। এখন শুধু অস্পষ্ট ধূসর এক নাম। যেন দূরের কুয়াশা ঢেকে দিয়েছে এক টুকরা আলোর মতো উজ্জ্বল এই নাম। দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করার মতো রিপোর্ট করেছেন মফস্বল শহর যশোরে বসে। একজন নিজস্ব সংবাদদাতা থেকে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার এবং রিপোর্টিং-শীর্ষপদ স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট বা বিশেষ


সংবাদদাতা হয়েছিলেন ঢাকার নামি দৈনিকের। স্রেফ মেধা, শ্রম, নিষ্ঠা আর পেশার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে অবিচল সাহসী শামছুর রহমান প্রমাণ করেছিলেন মফস্বল সাংবাদিকতা মোটেও হেলাফেলার কাজ নয়, এমনকি নয় অন্য পেশার ফাঁকে পত্রিকার জন্য কিছু খবরাখবর পাঠানো মাত্র। মফস্বল সাংবাদিকতাও যে পরিপূর্ণ পেশার বাহন হয়ে উঠতে পারে সেটা তার পূর্বসূরি মোনাজাতউদ্দিন যেমন দেখিয়েছিলেন, তেমনি দেখিয়ে গেলেন শামছুর রহমান। একজন মফস্বল সংবাদদাতাও যে শিক্ষিত এবং একই সঙ্গে স্বশিক্ষিত হয়ে রাজধানীর নামি রিপোর্টারদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন, হওয়া উচিত_ তারও স্বাক্ষর রেখে গেছেন ঘাতকের বুলেটে অকালে চিরবিদায় নেওয়া সাংবাদিক শামছুর রহমান। শামছুর রহমান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জনপদে কর্মরত সাংবাদিকদের কাছে শিক্ষণীয় এক আদর্শ হতে পারেন।
২০০০ সালের ১৬ জুলাই বিকেলেও যার সঙ্গে কথা বলেছি, সন্ধ্যায় সেই সহকর্মী ঘাতকের বুলেটে নিহত, এমন মর্মস্পর্শী খবর বজ্রপাতের মতো পেঁৗছেছে আমাদের কানে। আমি দৈনিক বাংলায় ঢোকার ২-৩ বছরের মধ্যে যশোরের নিজস্ব সংবাদদাতা নিযুক্ত হন কেবল। কবি শামসুর রাহমান তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক। যশোরে সাহিত্যের অনুষ্ঠানে গিয়ে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও করেন। রিপোর্টের ভাষায় যে প্রাঞ্জল গতি এবং বাক্যের শুদ্ধতা, তাতে সূচনাতেই আন্দাজ করা গিয়েছিল পঠন-পাঠনে কতটা ঋদ্ধ তার মানসলোক।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সন্ত্রাস, চোরাচালান আর সর্বহারা, সশস্ত্র ক্যাডার, অস্ত্র কেনাবেচা, মাদকের অন্ধকার জগৎ, আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ভয়াবহতা_ এসব ছিল তার রিপোর্টের প্রধান উপকরণ। বিশেষজ্ঞ বলা চলে ভারতীয় রাজনীতি বিষয়ে। তার যশোরের বাড়িতে ব্যক্তিগত সংগ্রহে দেখেছি উপমহাদেশের রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ে নানা ধরনের বই। পড়া ছিল নেশা। দেশের ভেতরেও ছিল উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। সামরিক বাহিনী থেকে গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে ছিল নিবিড় তথ্যসূত্র তথা যোগাযোগ। যখন যে পত্রিকায় কাজ করেছেন, সেখানেই সারাদেশের জেলা প্রতিনিধিদের সঙ্গে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরার সন্ত্রাস নিয়ে রিপোর্ট করতে যোগাযোগ করেছেন সিলেট-কক্সবাজার পর্যন্ত।
১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে যখন দৈনিক বাংলা ছেড়ে জনকণ্ঠে গেলাম, কিছুদিন পর সেখানেও সহকর্মী হিসেবে যশোরের ব্যুরো চিফ হিসেবে পেলাম তাকে। ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কভার করতে তাকে সারা ভারতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হলো। কলকাতা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ঘুরে, ভোটার, নির্বাচন কমিশন আর প্রার্থীদের বক্তব্য নিয়ে প্রতিদিন ছাপা হয়েছে রিপোর্ট। সমৃদ্ধ রিপোর্ট চোরাচালান, অস্ত্র, সন্ত্রাস আর মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে। সর্বহারা দমনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। কেবল একের পর এক দুর্ধর্ষ সাহসী রিপোর্ট করেছেন। সন্ত্রাসী আর চোরাচালান সিন্ডিকেট ক্ষুব্ধ। সাবধান করা হলো তাকে। কিন্তু অবিচল তিনি। লিখতে লিখতে লেখার টেবিলেই ২০০০ সালের ১৬ জুলাই সন্ধ্যায় জনকণ্ঠের যশোর ব্যুরো অফিসে আততায়ীর বুলেটে লুটিয়ে পড়লেন শামছুর রহমান কেবল। তার
উপন্যাস 'ধূসর সীমান্ত'র অস্ত্র, চোরাচালান জগতের খুনিরাই যেন তার ঘাতকের ছায়া! পেছনে রইল অসহায় তার বৃদ্ধ মা, এক ভাই, স্ত্রী আর কিশোরী কন্যা সেঁজুতি। মৃত্যুর কিছুদিন পর জন্ম নিল তার শিশুকন্যা, যে দেখল না তার পিতা কেমন।
শামছুর হত্যার ১২ বছর পার হয়ে যাচ্ছে, অথচ আজও হত্যার বিচার হলো না। ২০০১ সালে সিআইডি ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিল; কিন্তু চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি দুর্বল করে দেওয়া হলো নতুন করে তার বন্ধুদের আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বাদ দেওয়া হলো গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীও। মামলা স্থানান্তর হলো যশোর থেকে খুলনায়। উচ্চ আদালতে আপত্তি জানালেন তার স্ত্রী সেলিনা আক্তার, আর এগোলো না মামলা! এ কোন দেশ! কোন বিচার! এ প্রশ্নই আজ ঘুরপাক খায়।
 

No comments

Powered by Blogger.