চরাচর-আষাঢ়ের প্রথম দিন by আহমেদ রিয়াজ

গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানোর কথা যদি বলেন, তবে বর্ষাকালই সেরা। এ সময় মেঘেরা কেমন হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায় দেখেছেন? যেখানে খুশি সেখানে যাচ্ছে, যখন খুশি তখন। ইচ্ছা হলো তো মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল। বর্ষা ছাড়া এমন হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানোর সময় আর কখন?


বর্ষা আসে আষাঢ়ের হাত ধরে। বর্ষণমুখর আষাঢ়। হুট করে বৃষ্টি নামবে। এই বৃষ্টি, এই রোদ। এই না হলে আষাঢ়! তবু আষাঢ়ের পথ চেয়ে থাকি আমরা। বাদল দিনের আশায়। তবে শহুরে জীবনে বাদলা দিন মানেই বিরক্তির একশেষ। রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। নোংরা আর দুর্গন্ধময়। ব্যস্ত জীবনকে হঠাৎ থামিয়ে দেয়। জরুরি কাজগুলো সারা হয় না। কারো কাছে আবার বর্ষা প্রিয়। পত্রিকার পাতায় বর্ষার আগমন সংবাদ- 'বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল' কিংবা 'আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে'।
তবে যে যা-ই বলুক, বর্ষায় গ্রামবাংলার চেহারাটাই পাল্টে যায়। মাঠে মাঠে কচি ধানের চারা দুলতে থাকে হাওয়ায়। পাটের চারা মাথা তুলে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। কল কল পানির স্রোত বইতে থাকে খাল-বিলে। পাল তোলা নৌকা ছুটে চলে যায় কোথায় কোথায়। পুকুর পাড়ে কদম-কেয়াদের হৃদয় হরণ করা সুরভি। আকাশজুড়ে ব্যস্তবাগীশ মেঘেদের আনাগোনা তো আছেই। এসব দেখেই বুঝি রবি ঠাকুর বলেছিলেন- পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন নেচে ওঠে।
বর্ষার এমন উদ্দাম গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারে কয়জন? কালিদাসের মতো কয়জন পারে বর্ষার মেঘের খামে ভরে প্রিয়ার কাছে ভালোবাসার বার্তা পাঠাতে? কালিদাস, মেঘদূত আর বর্ষা নিয়ে ১৩৫৪ সালের ১লা আষাঢ় কবি শচীন্দ্রনাথ সেন লিখেছিলেন-
"আজি আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/কবি কালিদাসে পড়িল মনে,/অলকায় তিনি 'মেঘদূত' রূপে/পাঠায়েছিলেন এমনি দিনে।..." (আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে)
কেবল কবি আর সাহিত্যিকই নন, আষাঢ়ের ডাক সংগীতপিয়াসীদের কানেও বাজে। যেমন রাজশাহীর তানোরের জমিদারবাড়ির ছেলেরা মিলে গড়েছিলেন 'আষাঢ়ে ক্লাব'। নাহ্! এটা আষাঢ়ে গল্পের মতো ব্যাপার নয়। সত্যি সত্যি প্রতিবছর আষাঢ়ের প্রথম দিন থেকেই মাসব্যাপী এই ক্লাবের আয়োজনে বসত বিশাল গানের আসর। তানোরের জমিদার ব্রজেন্দ্র মোহন মৈত্রের ছেলে রাধিকা মোহন নিজেই ছিলেন বিখ্যাত সরোদশিল্পী। আষাঢ়ে গাওয়া হতো ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি। যেন আষাঢ় ছাড়া এসব জমেই না। বাজানো হতো সেতার, সরোদ, এস্রাজ।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি। আর ঘরের ভেতর গান। শিল্প-সাহিত্যে বাঙালির মতো এমন রসিক আর কারা? রাজশাহীর পুরনো দিনের অনেক মানুষ এখনো হয়তো আষাঢ়ে ক্লাবের কথা ভোলেননি।
আমরা যতই শহুরে হই না কেন, আষাঢ়ের প্রথম দিনটিকে মনে রাখি বা না রাখি- তাতে আষাঢ়ের কিছু যায় আসে না। উল্টো বৃষ্টিমুখর দিনে ঘরে থেকে বৃষ্টি উপভোগের যে আনন্দ, স্মৃতিকাতরতার যে আকুতি- সেটা আর কোন ঋতুটা দিতে পারে? আর বর্ষণমুখর সে দিনটি যদি আষাঢ়ের প্রথম দিনই হয়, আর ভাগ্যগুণে ছুটির দিন হয়, তবে কেমন হবে?
আহমেদ রিয়াজ

No comments

Powered by Blogger.