আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৮০)-ঢাকার কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস by আলী যাকের

এই সময় ভারত বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে আশ্রয় দেয়। বাংলাদেশ থেকে আগত এক কোটির ওপর শরণার্থীকে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় প্রদান করা হয়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ সামরিক প্রশিক্ষণ দেয় তারা এবং পরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এগিয়ে আসে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে।


সেই যুদ্ধে আত্মাহুতি দেয় কয়েক হাজার ভারতীয় সৈন্য। এ কথা নিঃসংকোচে স্বীকার করতে হয় যে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দূরদৃষ্টি এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাই ভারতকে উদ্বুদ্ধ করে বাংলাদেশের সহায়তায় এগিয়ে আসতে। উল্লেখ্য যে আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকীতে, তখন কেউ কেউ বলে বেড়ান, ভারত নিজ স্বার্থে এই যুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছিল। অবশ্যই করেছিল। বিশ্ব ইতিহাসে একটি তৃতীয় দেশ কোনো একটি বিশেষ পক্ষ অবলম্বন করে কোনো স্বার্থ ছাড়া, তার কোনো নজির অন্ততপক্ষে আমার জানা নেই। একেবারে চাঁচাছোলা ভাষায় বলতে গেলে বলতেই হয়, এই যুদ্ধে ভারতের স্বার্থ ছিল পাকিস্তানকে দুর্বল করে দেওয়া। কেননা ভারতের দুই পাশে দুই ধর্মান্ধ এবং সাম্প্রদায়িক বৈরী শক্তি যদি ক্রমাগত যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে ভারত বিরোধিতা করে, তাহলে ভারতের পক্ষে যুদ্ধবাজ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। অথচ ভারত প্রজাতন্ত্রের জন্ম একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। তারা কখনোই কোনো অজুহাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হতে চায়নি। তাই স্বভাবতই তারা চাইত, তাদের মানুষের কল্যাণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক উন্নয়নের খাতে তাদের বাজেটের বেশির ভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হোক; কিন্তু সিংহভাগ অর্থই যদি কেবল প্রতিরক্ষায় ব্যয়িত হয় তাহলে ভারতের এই আদর্শ ক্ষুণ্ন হয় বৈকি। এটাই ছিল ভারতের মূল স্বার্থ এই যুদ্ধে এগিয়ে আসার। আর পাকিস্তান যে একটি যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র, তা তাদের পরবর্তী ইতিহাস দেখলে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। আজকে ভারতের সঙ্গে তাদের কোনো যুদ্ধাবস্থা নেই। অথচ পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থা থেকেও নৃশংস একটি সময় পার করছে এখন। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নিজ ধর্মের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সংঘর্ষ, সামরিক-অসামরিক দ্বন্দ্বের প্রাদুর্ভাব- এ সবই পাকিস্তানকে এখন একটি ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধে ভারতের সমর্থন দেওয়ার পেছনে একটি মানবিক কারণও ছিল বটে। যে কথাটি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারি সুন্দর ভাষায় বলেছিলেন, খুব সম্ভবত বিদেশে কোনো এক সম্মিলনে। তিনি বলেছিলেন, 'আমার প্রতিবেশীর ঘরে যদি আগুন ধরে এবং সে যদি আমার কাছে তখন আশ্রয় চায়, আমি তার মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে তাকে আবার তার জ্বলন্ত বাসগৃহে ফেরত পাঠাতে পারি না।'
শীল লেন বলে একটি গলিতে ত্রিতল ভবনের একটি ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছিলেন আমার বড় খালাতো বোন এবং দুলাভাই জনাব আবুল খায়ের এমএনএ। এই বাড়ির দোতলায় এসে উঠলেন চারুশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তখন পিটিভির মহাপরিচালক ছিলেন জামিল চৌধুরী। এই দুজন ব্যক্তি গোটা মার্চ মাসেই বাংলাদেশের পক্ষে এবং প্রকারান্তরে পাকিস্তানের বিপক্ষে অনেক অনুষ্ঠান পরিবেশনের সুযোগ করে দেন, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। ড. নওয়াজেশ আহমদ, আমাদের আহমদ ভাই জীবনানন্দ দাশ এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতার ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু স্থিরচিত্র তুলেছিলেন। সেসব ছবি নিয়ে হৃদয়গ্রাহী ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয় এবং গোটা মার্চ মাস পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। ওইসব অসাধারণ অনুষ্ঠান দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবস। একাত্তরের ওই দিন গোটা বাংলাদেশের কোথাও এই বিশেষ দিবসটি উদ্যাপিত হয়নি। পিটিভিতেও জামিল চৌধুরী এবং মুস্তাফা মনোয়ারের নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে ওই দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠান খুবই কম প্রচার করা হয়। তখন রাতের অনুষ্ঠান শেষ হতো রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে। সেই সময় পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজানো হতো, সঙ্গে দেখানো হতো পাকিস্তানি পতাকা। ওই রাতে মুস্তাফা মনোয়ার ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানি জাতীয় সংগীত প্রচার করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুষ্ঠান প্রলম্বিত করে রাত ১২টার পর একটি ভিন্ন ধরনের ঘোষণা দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেন। ওই দিন পিটিভির ২৩ তারিখের অনুষ্ঠান শেষের ঘোষণাটা অনেকটা এ রকম ছিল : 'আজ ২৪শে মার্চ। আমরা আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি...'। তারপর বাজানো হয় পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত।
যা হোক, প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা বাদল রহমানও প্রথমে মুস্তাফা মনোয়ারের সঙ্গে এসে শীল লেনের ওই বাড়িতে ওঠেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসেন তিন তলায় আমার বড় আপাদের সংসারে। বড় আপাদের সঙ্গে আরো থাকত আমাদের বন্ধু লুৎফর রহমান খোকা এবং রফিউজ্জামান তরফদার। নজরুল গীতির স্বনামধন্য শিল্পী, আমার খালাতো ভাই বেনুও ঢাকা থেকে ওর সদ্য বিবাহিত বউকে নিয়ে কলকাতায় তার আপন বোন ও দুলাভাইয়ের সঙ্গে ওই একই ফ্ল্যাটে এসে ওঠে। ও বিয়ে করে ছায়ানটেরই ছাত্রী, নজরুল গীতির শিল্পী শাহীনকে। বেনু, খোকা এবং আমাদের বন্ধু নুরুল, সগীর, লিটু ট্রেনিং নিয়েছিল সেক্টর ৮-এ আমাদের বন্ধু ক্যাপ্টেন হাফিজের ক্যাম্পে। আমি আমার কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যেই যেতাম বড় আপাদের বাসায়, অধিকাংশ দিন সব কাজ শেষে রাতের বেলায়। সেসব পুরনো দিনের কথা এবং আমাদের প্রিয় শহর ঢাকার কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। আমরা সবাই কোনো না কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম বেশির ভাগ দিন এবং অনেক সময় সারা রাত জেগে; কিন্তু বড় আপার বাসায় ওই অল্প সময়ের আড্ডা আমাদের নতুনভাবে সঞ্জীবিত করত।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.