ঢাকা বাঁচলে দেশ বাঁচবে by ইফতেখার আহমেদ টিপু

নগরায়ণ ও জাতীয় অগ্রগতি সমার্থক শব্দ হিসেবে বিবেচিত। একটা জাতি কতটা উন্নত, তা সে জাতির নগরায়ণের চিত্র দেখলেই অনুমান করা যায়। ৪০ বছর আগের বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের পার্থক্য কতটা, তা শুধু ঢাকা মহানগরীর দিকে তাকালেই অনুভূত হবে।


বলা যায়, এ মুহূর্তে ঢাকা মহানগরীতে যত গাড়ি চলে, যত দালানকোঠা-স্থাপনা রয়েছে, চার দশক আগে সারা দেশে যে পরিমাণ গাড়ি চলত, যে পরিমাণ দালানকোঠা ছিল তার চেয়ে অন্তত ১০০ গুণ বেশি। এখন ঢাকায় যে পরিমাণ লোকের নিজস্ব গাড়ি রয়েছে চার দশক আগে সারা দেশে তার ১ শতাংশ লোকেরও গাড়ি ছিল না। দেশের শিল্পায়নের হারও অনেক বেড়েছে। তবে সেই সঙ্গে বেড়েছে দূষণের মাত্রাও। একটা দেশ এগিয়ে যায় তার রাজধানীকে কেন্দ্র করে। সে রাজধানী যদি অচলাবস্থার শিকার হয়, তবে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রাণচাঞ্চল্য বিঘি্নত হতে বাধ্য।
দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একটি দল বিশ্বের ১৪০টি শহরের ওপর জরিপ শেষে জানিয়েছে, বাংলাদেশের রাজধানীর স্থান বসবাসের অযোগ্য শহরের দিক থেকে দ্বিতীয়। এ তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারের স্থান। দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রয়োজনের তাগিদে বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঢাকায় বসবাস করতে হয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক হওয়ায় গ্রাম ও শহর প্রায়ই নদীভাঙনের কবলে পড়ে এবং উচ্ছেদ হওয়া জনগণ আশ্রয় ও কাজের আশায় ঢাকার দিকে ধাবিত হয়। এদের মাথা গোঁজার স্থান হয় বিভিন্ন বস্তির ঝুপড়িতে। একটি পরিকল্পিত নগরীতে রাস্তা থাকা উচিত ২৫ শতাংশ। ঢাকা নগরীতে রাস্তা আছে মাত্র ৮ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর শহরে রাস্তা রয়েছে ১৫ শতাংশ। কিন্তু তাদের বসতিগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব ঢাকার তুলনায় অনেক কম।
ঢাকার পাবলিক পরিবহনব্যবস্থা নিম্নমানের এবং চলাচলে শৃঙ্খলা নেই। ফলে জনগণ এসব পাবলিক পরিবহনব্যবস্থা ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। একই রাস্তায় বিভিন্ন গতির গাড়ি চলাচল করায় তাদের গতি হয় বাধাগ্রস্ত ও নিয়ন্ত্রিত। ফুটপাতগুলো ভাঙাচোরা, অনেক স্থানে তাও নেই। যেখানে ফুটপাত আছে তাও হকারদের দখলে। বৃষ্টি হলেই রাস্তাগুলো জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে, পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব নিউ ইয়র্ক শহরের চেয়ে প্রায় ১৭ গুণ বেশি। ঢাকা নগরীর ড্রেনেজ, স্যুয়ারেজ, বিদ্যুৎ, পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সক্ষম কি না তা হয়তো বিবেচনায় না নিয়েই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আবাসিক এলাকাগুলোতে বিভিন্ন সময়ে প্রথমে দোতলা, পরে ছয়তলা, এখন আবার চৌদ্দতলা ভবন নির্মাণ করার অনুমতি দিয়ে জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছে।
ঢাকা শহরের বর্তমান অবকাঠামোগত যে সমস্যা, এখানে অনেক বেশি নতুন রাস্তা তৈরি করা সম্ভব হবে না। তাই সীমিত রাস্তাগুলোকে বিভিন্নভাবে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। ঢাকা শহরের আশপাশ থেকে যাতায়াত করে অফিস-আদালতে কাজ করার সুবিধা অপ্রতুল। ফলে তাদের কষ্ট হলেও ঢাকায়ই বসবাস করতে হয়। পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন করা হলে বহু লোক নিকটবর্তী শহরগুলো থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে অফিস ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সক্ষম হবে। রাস্তার ক্রসিংগুলোতে ফ্লাইওভার ব্রিজ নির্মাণ করে গাড়ি চলাচলে স্থবিরতা দূর করতে হবে।
পাতালরেল নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে বটে; কিন্তু পাতালরেল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তা ছাড়া ঢাকা নগরীর মাঝেমধ্যে বন্যায় তলিয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে নির্মাণকাজে সীমাবদ্ধতা, ঢাকার সয়েল কন্ডিশন, অত্যধিক খরচের যৌক্তিকতা ইত্যাদি বিশেষভাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। রেল হোক বা রাস্তাই হোক, তাতে চলাচলব্যবস্থা চালু রেখে রেল বা সড়কের বর্তমান এলাইনমেন্টে পাতালরেল বা মেট্রোরেল করা কতটা যৌক্তিক তা যাচাই করে ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাজধানীর জনসংখ্যা কমায় গার্মেন্টসহ শিল্প-কলকারখানা ঢাকার বাইরে স্থানান্তরের কথা ভাবতে হবে। পরিবেশ উন্নত করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার কাছে দেওয়া দরকার। কেউ যেখানে-সেখানে ময়লা ফেললে, রাস্তা নষ্ট করলে এমনকি নদী অথবা জলাশয়ে আবর্জনা ফেললে তারা সঙ্গে সঙ্গে জরিমানার ব্যবস্থা করতে পারবে।
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্পর্শকাতরতা জড়িত এ নগরীর সঙ্গে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ৪০ বছর আগে স্বাধীন দেশের রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও সব ক্ষেত্রে যথেচ্ছতা ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত করেছে। এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। মনে রাখতে হবে, রাজধানী ঢাকা হলো দেশের হৃৎপিণ্ড। ঢাকা বাঁচলে দেশ বাঁচবে।

লেখক : ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষক, চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ

No comments

Powered by Blogger.