রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ হচ্ছে by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

দীর্ঘদিনের অপেক্ষা আর আন্দোলনের পর সরকারীকরণ হতে চলেছে ২৪ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকার এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরির কাজও শুরু হয়ে গেছে।


প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ গতকাল সাংবাদিকদের জানান, রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ সম্পর্কিত একটি নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে শেখ হাসিনা এই নির্দেশ দেন।
প্রেসসচিব জানান, জাতীয়করণের কাজটি তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। সরকারের অনুমোদন ছাড়া এখন থেকে নতুন কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমানে যেসব আবেদন জমা আছে, সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে।
সারা দেশে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৪ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৯৬ হাজার। আর শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ। শিক্ষকরা তাঁদের প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের দাবিতে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন। এই সময়কালে দুজন শিক্ষককে প্রাণও দিতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা আন্দোলনের অবসান হলো বলা যায়।
সর্বশেষ ১৯৭৩ সালে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা দেশের ৩৭ হাজারের কিছু বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। ৩৯ বছর পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার আবার তেমন একটি ঘোষণা দিল। প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শিক্ষকরা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. মো. আফসারুল আমীন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরই চাকরি জাতীয়করণের বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। দুপুরেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিবকে নির্দেশনা দিয়ে বলেছি এসব বিদ্যালয়কে কিভাবে জাতীয়করণ করা যায়, এর কৌশল নির্ধারণ করে একটি সুপারিশ জমা দিতে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী চাকরি জাতীয়করণের কাজ শুরু হবে।' মন্ত্রী বলেন, 'জাতীয়করণের ক্ষেত্রে ওই সব বিদ্যালয়ই প্রাধান্য পাবে, যারা কয়েক বছর ধরে প্রাধমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় বিধি মোতাবেক অংশগ্রহণ করে আসছে এবং পরীক্ষায় পাসের হার ভালো ছিল। এ ছাড়া জাতীয়করণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলো কিভাবে নিবন্ধিত হয়েছে, তাও খুঁজে দেখা হবে।'
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর এমন নির্দেশনা পেয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে জাতীয়করণের কৌশল নির্ধারণে আলোচনা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। আর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইউনিটের মহাপরিচালক আবদুল হালিম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সচিব মহোদয় দুপুরে আমাদের একটি গাইডলাইন দিয়েছেন। সেই অনুসারে অধস্তনদের কাজ করার নির্দেশ দিয়েছি। আশা রাখি, সুপারিশ প্রণয়নের কাজ শিগগির শেষ হবে।'
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী সরকারের এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতেরও ব্যবস্থা করল। শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্যও কমিয়ে আনল। এ ঘোষণার বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কিভাবে হয় সেদিকে আমাদের নজর থাকবে।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চামেলী হলে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বৈঠকটি শুরু হয়। শিক্ষকদের তরফে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, কো-চেয়ারম্যান শেখ আবদুস সালাম মিয়া, সদস্যসচিব আবদুর রহমান বাচ্চু ও যুগ্ম সদস্যসচিব মাহবুব আলমের নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের প্রতিনিধিদল ছিল। আর সরকারের তরফে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের মহাপরিচালক ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর প্রেসসচিব সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণের দাবি প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ভিত্তিতে পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকরা আগামী ১৬ জুন থেকে স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।
ঐক্য পরিষদের কো-চেয়ারম্যান শেখ আবদুস সালাম মিয়া বলেন, 'বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন। আমরা বলেছি, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যেন শিক্ষকদের মহাসমাবেশ থেকে ঘোষণাটা দেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিনের মধ্যে মহাসমাবেশের সময় নেওয়ার জন্য বলেছেন।'
প্রসঙ্গত, চাকরি সরকারীকরণের দাবিতে ১৯৯১ সাল থেকে শিক্ষকরা আন্দোলন করে আসছেন। সর্বশেষ ১৩ মে থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে পদযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। ওই কর্মসূচিতে পুলিশের বাধাদান ও লাঠিপেটায় বেশ কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। অসুস্থ হয়ে পড়েন কয়েকজন শিক্ষক। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই একজন শিক্ষক অকালে মৃত্যুবরণ করেন।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ মে কালের কণ্ঠে 'শিক্ষকদের গায়েও হাত তুলছেন!' শিরোনামে সম্পাদকের কলাম লেখেন কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। তিনি তাঁর লেখায় নিরীহ শিক্ষকদের ওপর লাঠি নিয়ে হামলে পড়া পুলিশ সদস্যদের মনে করিয়ে দেন, এসব শিক্ষক একদিন তাঁদের জীবনও গড়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি লেখেন, 'বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাঁর রাজনীতির মূলে ছিল সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনা ঘোচানোর চেষ্টা, তাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই রাজনীতিই তিনি করে গেছেন। তাঁর যোগ্য কন্যা, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও পিতার রাজনৈতিক আদর্শই লালন করেন। ২০০৩ ও ২০০৫ সালে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করা হবে। এই দাবি বাস্তবায়নের আশা নিয়েই শিক্ষকরা এসেছিলেন তাঁর কাছে। বিনিময়ে পুলিশের লাঠি পড়ল তাঁদের পিঠে, জলকামানের গরম পানি পুড়িয়ে দিল তাঁদের যাবতীয় স্বপ্ন। জীবন দিলেন আজিজুর রহমান স্যার।'
বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে ইমদাদুল হক মিলন লেখেন, 'বাংলাদেশের বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক লাখখানেক। তাঁরা বেতন পান সর্বসাকল্যে ৫০০০ টাকা। দাবি পূরণ হলে তাঁদের দুঃখী জীবনে একটুখানি সচ্ছলতা আসত। আর এই দাবি পূরণে সরকারের ব্যয় হতো ৪৩০ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কটা কি খুব বেশি?'

No comments

Powered by Blogger.