এ মৃত্যুর দায় কার? by এমএম কবীর মামুন

গত ১৯ মে নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় নানার বাড়িতে বেড়াতে আসা ৭ বছরের এক আদিবাসী শিশু সাগরী উরাঁওকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী মহম্মদপুর গ্রামের আতাউরের পুত্র ভটভটিচালক নান্নু মিয়া ১৯ মে রাতে তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে রক্তাক্ত অবস্থায় কলাগাছের মধ্যে ফেলে রেখে যায়।


খবরটি দেখার পর থেকেই বারবার একটি কথা মাথার মধ্যে ঘুরছে, এর দায় কার? এর দায় কি আমাদের সকলের নয়? দেশের সকল বিবেকবান মানুষের নয়? বিবেকবান মানুষদের কি ঘুরে দাঁড়ানো উচিত নয় এই ঘটনার প্রতিবাদে। দু'একটি ছোটখাটো প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়। তা করেছে আদিবাসী পরিষদ। আজকে আদিবাসী শিশু ধর্ষিত হয়েছে বলে দায় কি শুধু আদিবাসী পরিষদের একার? আর দশটি খবরের মতো এই ঘটনার রিপোর্ট হয়েছে পত্রিকাতে। থানায় পুলিশবাদী একটি মামলা হয়েছে। এর ভবিষ্যৎ কী তা কেউ জানে না। এ রকম অনেক ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে। মানুষ সাময়িক আহত হয় আবার পরদিন ভুলে যায়। কারণ, বাংলাদেশে প্রতিদিন এত দুর্ঘটনা ঘটে যে পরের ঘটনা সামনে এলে মানুষ আগেরটা ভুলে যায়। আবার আহত হয় এবং আবার ভুলে যায়। গত ৯ এপ্রিল একই ধরনের ঘটনা ঘটে পাহাড়ি জেলা রাঙামাটিতে। সেদিন রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার আটরকছড়া ইউনিয়নের ১১ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সুজাতা চাকমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটিয়েছিল ইব্রাহিম। এই ঘটনার ১১ মাস আগে ইব্রাহিম সুজাতার মামাতো বোনকেও ধর্ষণ করেছিল। এ রকম ঘটনা মনে করতে গেলে বহু ঘটনাই চোখের সামনে ভিড় করতে থাকে। ২০১১ সালের মে মাসে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছিল সুনিকা চাকমাকে। এর কিছুদিন পরই রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় মরিয়ম মুরমু নামের এক সাঁওতাল নারীকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আদিবাসী নারীদের ওপর একের পর এক ঘটে যাচ্ছে এ ধরনের পৈশাচিক নিপীড়ন। এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। শুরু থেকেই নিপীড়ন চলছে আদিবাসীদের ওপর। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে আদিবাসীরা বসবাস করেন, সকল অঞ্চলেই একই ধরনের অথবা প্রায় কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের নির্যাতন প্রায় প্রতিদিনই সংঘটিত হয়। খবরের কাগজ খুললেই যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে পোরশার ৭৩ আদিবাসীর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় আয়োজিত একটি বিক্ষোভ সমাবেশে কয়েকজন জাতীয় পর্যায়ের বামপন্থি নেতা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া আদিবাসীদের ওপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় আদিবাসীদের সংগঠনগুলোই প্রতিবাদ এবং নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে। কিন্তু দরিদ্র আদিবাসীদের গরিব সংগঠনগুলো অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শক্তি এবং সামর্থ্য কিছুই রাখে না। আর অন্যেরা তাদের সমস্যায় কথা বলে খুব কমই।
আদিবাসীদের সমস্যার কথা কি শুধু আদিবাসীদেরই বলতে হবে। আর কারও কি কোনো দায়িত্ব নেই? আজকে ৭ বছর বয়সী শিশু সাগরী উরাঁওকে যে ধর্ষণ এবং হত্যা করা হলো তার দায় কি সকলের নয়? সকলে মিলে কি একসঙ্গে এর প্রতিকার চাওয়া যায় না? এর দায় যেমন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের, তেমনি সরকারেরও। বৃহত্তর বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাইরে প্রায় অর্ধশতক ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী আলাদা জাতিসত্তাগুলো এই বাংলাদেশের বৈচিত্র্য। কোনো রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তাদের যে কেউ অস্বীকার করতে পারেন। তার মানে এই নয় যে, তারা নেই। আদিবাসীরা এই দেশেরই বাসিন্দা। তারা এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালিদের মতোই হাতে অস্ত্র ধরেছিল। সাগরী উরাঁওয়ের ধর্ষক এবং হত্যাকারীর বিচার করতে হবে। বিচারের নামে প্রহসন অবশ্যই কাম্য নয়। অবিলম্বে সাগরী উরাঁওয়ের ধর্ষক এবং হত্যাকারীর বিচারের পাশাপাশি অতীতে সংঘটিত আদিবাসীদের ওপর সকল নিপীড়নের বিচার হবে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বর্তমান সরকারের কাছে সকল বিবেকবান মানুষের এটাই প্রত্যাশা।
krmamun334@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.