ইউরোপীয় গণতন্ত্রের সংকট by অমর্ত্য সেন

অনেক সময় উদ্দেশ্য ভালো হলেও যে রসাতলে যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হয় তার প্রমাণ ইউরোপের গৃহীত নীতি। এর কারণেই ইউরোপে আজ অর্থনৈতিক সংকট। এটা বিশ্বে দুর্দশা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এর কারণও রয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে অধিকতর ভালো অর্থনৈতিক জবাবদিহিতা ও অধিকতর দায়িত্বশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন থেকেই দরকার ছিল।


তবে সময় নির্বাচনটা গুরুত্বপূর্ণ; চরম ব্যস্তগতিতে করা সংস্কার আর সুচিন্তিত সময়সীমায় সংস্কারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে হয়। গ্রিস জবাবদিহিতায় সমস্যা থাকার পরও ২০০৮ সালে বৈশ্বিক মন্দার আগে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েনি। বস্তুত গ্রিসের অর্থনীতি ২০০৬ সালে ৪.৬ মাত্রায় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল এবং ২০০৭ সালে এর প্রবৃদ্ধি হয় ৩ শতাংশ। এরপরই শুরু হয় অব্যাহতভাবে গ্রিস অর্থনীতি পতনের ধারায় নিমজ্জিত হওয়া।
সংস্কারটা যতই জরুরি বলে বিবেচিত হোক না কেন, এটার একতরফা প্রয়োগ এবং আকস্মিক ও নির্মমভাবে সরকারি সেবা কর্তন সুফল দেয়নি। এভাবে বাছবিচারহীনভাবে সেবা কর্তনের ফলে বাজারে চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। আসলে এটা একটা কুফল দায়ী কৌশল। এর ফলে বিপুল বেকারত্ব দেখা দেয় এবং শ্রমনির্ভর নয় এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার চাহিদার অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। উৎপাদনশীলতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া দেশ গ্রিসের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য ইউরোপের আর্থিক নীতির (মুদ্রার অবমূল্যায়ন) আওতায় আর্থিক প্রণোদনা কর্মসূচি নেওয়া হয়। অথচ ইউরোপীয় নেতারা যে রাজস্ব নীতি বাস্তবায়ন দেখতে চান তা মারাত্মকভাবে প্রবৃদ্ধিবিরোধী। গত বছর চতুর্থ কোয়ার্টারে ইউরো জোনের অর্থনৈতিক উৎপাদন শক্তি হ্রাস অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতি এমনি দাঁড়ায় যে, সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে ইউরো জোনের প্রবৃদ্ধি শূন্য প্রাক্কলন করার পর সেটাই ভালো সংবাদ হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।
বস্তুত ঘাটতি হ্রাস করার কার্যকর পন্থা হলো এর সঙ্গে দ্রুত প্রবৃদ্ধিকে যুক্ত করা এবং এর পক্ষে যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণও রয়েছে। দ্রুত প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে অধিকতর রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিপুল ঘাটতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে অপসৃত হয় এবং এ ধরনের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রে বিল ক্লিনটনের শাসনামলে। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে সুইডেনের প্রশংসিত বাজেট ঘাটতি হ্রাসও মূলত দ্রুত প্রবৃদ্ধির কারণেই সম্ভব হয়। এর বিপরীতে ইউরোপীয় দেশগুলো আজ যখন শূন্য বা নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফাঁদে আটকা রয়েছে, তখন তাদের ঘাটতি হ্রাসের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
এখানে নিশ্চিতভাবেই আমরা কেইনসের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তিনি রাষ্ট্র ও বাজারের পরস্পর নির্ভরশীলতাকে ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে রাজনৈতিক অঙ্গীকারসমেত যে সামাজিক ন্যায়বিচারের আবশ্যকতা দেখা দেয়, সেটা সম্পর্কে কেইনসের তখন বলার মতো অবস্থা দেখা দেয়নি। এটাই ইউরোপে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র ও জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার জন্ম দেয়। এটা বাজার অর্থনীতিকে সমর্থন জোগানোর জন্য নয়, মানবজাতির কল্যাণের জন্য উদ্দেশ্যতাড়িত।
যদিও সেই আমলে সামাজিক ইস্যুর ব্যাপারে কেইনস ততটা গভীরভাবে জড়িত হননি, তথাপি অর্থনীতির একটা অতি পুরনো ঐতিহ্য হলো দক্ষ বাজারের নিশ্চয়তার সঙ্গে সঙ্গে বাজার ব্যবস্থা সাধারণের যেসব সেবা নিশ্চিত করতে পারে না সেসবের ব্যাপারে বিধিবিধান রাখা। অ্যাডাম স্মিথ (সাধারণত মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রথম গুরু বলা হয়) 'দি ওয়েলথ অব নেশনস'-এ লেখেন, অর্থনীতির দুটি স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য থাকে। প্রথমত, প্রচুর আয় বা জনগণের জীবন নির্বাহের জন্য অথবা আরও যথাযথভাবে বলতে গেলে এ ধরনের আয় যেন তাদের জীবনোপায়ের কাজে লাগে, তার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র বা কমনওয়েলথকে জনগণের সেবা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত আয়ের ব্যবস্থা করা।
ইউরোপের বর্তমান দুর্দশার কারণ হলো, এখানে গণতান্ত্রিক অঙ্গীকারের জায়গায় অর্থনৈতিক নির্দেশনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ অংশীদারিত্বমূলক সাধারণের আলোচনার মাধ্যমে ইউরোপের সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তির প্রতি হুমকি সৃষ্টি না করে সরকার একটি গ্রহণযোগ্য সময়ের মধ্যে যথাযথ সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারতেন। গণতান্ত্রিক তাত্তি্বক জন স্টুয়ার্ট মিল ও ওয়াল্টার বাগট এই তত্ত্বই ব্যাখ্যা করেছেন। অথচ এর বিপরীতটাই দেখা গেল। তেমন সাধারণ আলোচনা ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনগণের সম্মতি ছাড়াই জনসেবা খাতে ব্যয় ব্যাপক কাটছাঁট করা হলো। এর ফলে ইউরোপের মানুষ ব্যাপকভাবে চরম বাম ও চরম দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে গেল।
এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, ইউরোপ একপক্ষীয় মতামতের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে পারে না অথবা জনগণের মতামত ছাড়া শুধু বিশেষজ্ঞদের ভালো উদ্দেশ্যতাড়িত মতামতের ওপর নির্ভর করতে পারে না। ইউরোপে একটার পর একটা নির্বাচনে এ কারণেই জন-অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে। গণতন্ত্র ও ভালো নীতি তৈরি করার সুযোগ_ উভয়ই ইউরোপীয় নেতাদের নির্দেশিত অকার্যকর ও নির্জলা অন্যায্য নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অমর্ত্য সেন :নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং হার্ভার্ডের অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.