পুলিশের রুদ্ররোষে সাংবাদিক-এটা সভ্য সমাজের চিত্র হতে পারে না

২৬ মে, ২০১২ তারিখে 'মহাজোট সরকারের তিন বছর : গণমাধ্যম ও তথ্য অধিকার' শীর্ষক এক সেমিনারে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, 'সাংবাদিকবান্ধব এ সরকার সাংবাদিকদের ব্যাপারে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। সব ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা দিয়েছে সরকার।'


কিন্তু তাঁদের এই বক্তব্য যে কতটা অসার ওই দিনই ঢাকায় পুলিশের নিষ্ঠুর, বর্বর, অমানবিক আচরণই এর বড় প্রমাণ। প্রকাশ্যে রাজপথে তিন সাংবাদিককে মহাউল্লাসে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে পুলিশ। শনিবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের ছাত্রীদের বিক্ষোভের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের নির্মমতার শিকার হন ফটো সাংবাদিকরা। আক্রান্তদের শরীরে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন ও উৎসব করে পুলিশের সাংবাদিক পেটানোর সচিত্র প্রতিবেদন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। কোনো সভ্য সমাজে এমন দৃশ্য বা চিত্র অভাবনীয় হলেও এমন ঘটনা যে এই প্রথম ঘটেছে, তা নয়।
বিদ্যমান ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দাঁড়ায়, সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক কি সাপে-নেউলে? যখন কোনো পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা সদস্যকে উল্লাস করে সাংবাদিক পিটিয়ে আক্রোশ মেটাতে দেখা যায়, তখন খুব স্বাভাবিক কারণেই এ প্রশ্নও জাগে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন নির্যাতনের কারণ কী? সমাজের নানা অশুভ শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও প্রায়ই নির্যাতন-নিপীড়ন-হয়রানির শিকার হচ্ছেন পুলিশ-র‌্যাব এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার, এমন দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে অনেক। সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অপতৎপরতা অত্যন্ত বেগবান। অতীতের মতো মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও আমরা লক্ষ করছি যে সারা দেশে সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন মহলের শীর্ষজনদের সাংবাদিকদের ব্যাপারে 'সরকার সহানুভূতিশীল' এমন মন্তব্য পরিহাস নয় কি? গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল, সাংবাদিকতা পেশাও মুক্ত পরিবেশ ফিরে পাবে। এ কথা সত্য যে প্রকাশ্যে বিধিনিষেধ না থাকলেও পেশার ঝুঁকি দূর হয়নি। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এবং ২৬ মে ২০১২ তারিখের ঘটনা এর পুনঃ প্রমাণ। এ দেশে অব্যাহতভাবে সাংবাদিক নিগ্রহের যে ঘটনা ঘটছে, তা যেকোনো সভ্য সমাজে অকল্পনীয়। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সরকার কিংবা সমাজের যেসব মহল বাধার প্রাচীর দাঁড় করাচ্ছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত বা অনভিপ্রেতই নয়, প্রশ্নবোধকও বটে। অশুভ শক্তিমুক্ত যে সমাজের প্রত্যাশা সাধারণ মানুষ করে, তা এর বিপরীত। তিনজন সাংবাদিককে পেটানোর ঘটনায় ইতিমধ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন টোটকা দাওয়াইয়ে এই গুরুতর রোগ সারবে না। অতীতেও এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; কিন্তু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কালো দাগ মুছে যায়নি। কঠোর আইনি প্রতিকার ভিন্ন এর দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। উপর্যুপরি বর্বরোচিত ঘটনা ঘটিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার মধ্য দিয়েই সব দায় শেষ করার কৌশল যেমন ভালো নয়, তেমনি এটা নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। আমরা চাই কঠোর আইনি প্রতিকার, যা দৃষ্টান্ত হিসেবে অন্য বলবানদেরও হাড় কাঁপাবে।

No comments

Powered by Blogger.