শ্রদ্ধাঞ্জলি-আমাদের বাদল ভাই by সাইদুল আনাম টুটুল

চলে গেলেন বাদল ভাই। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৭ সাল থেকে। তখন আমি তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্রে (ডিআইটি বিল্ডিং, বর্তমানে রাজউক ভবন) ছোটদের বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। বিশেষ করে টেলিভিশনে মুস্তাফা মনোয়ারের পুতুলনাচের যে অনুষ্ঠান হতো, তাতে আমি যুক্ত ছিলাম।


সেখানেই বাদল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। বাদল ভাই তখন বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। আমি ভুল না করে থাকলে বলতে পারি, ভাসানীপন্থী ন্যাপের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। শান্তিনগর এলাকায় ছিলাম। তাই একটা পরিচয় ছিল পাড়াগত, অন্যটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে, অর্থাৎ শান্তিনগর ও টেলিভিশনে গড়ে ওঠে আমাদের সখ্য।
আমি যখন ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হই, তখন সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। ভালো ছবি দেখা, সেই ছবি নিয়ে কথা বলা চলতে থাকে। সে সময় সেখানেও আমি বাদল রহমানকে পাই। এরপর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এল। আমি আমার মতো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলাম। বাদল ভাই যোগ দিলেন তাঁর মতো করে। আমি ছিলাম হাকিমপুর-ভাদিয়ালী সীমান্ত ক্যাম্পে। সেক্টর এইট, কোম্পানি ই। আমি এর মধ্যে কলকাতা গিয়েছিলাম আমার ভগ্নিপতি তোয়াব খানের কারণে। তিনি তখন যুদ্ধের মধ্যে পালিয়ে কলকাতায় চলে এসেছেন। তাঁদের জন্য কলকাতায় বাড়ির ব্যবস্থা করতে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে আমি কলকাতায় এসেছিলাম। সে সময় একদিন চলতি পথে সৈয়দ হাসান ইমামের সঙ্গে দেখা। তিনিই আমাকে নিয়ে গেলেন বাংলাদেশিদের নিয়ে গঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠনের অফিসে। সেখানে সংগীতশিল্পী ও নাট্যশিল্পীদের অনেকেই ছিলেন। মুস্তাফা মনোয়ার ও বাদল রহমানকে সেখানে পেলাম। বাদল ভাই আমার কাছ থেকে আমার ঠিকানা রেখে দিলেন। আমি আবার ক্যাম্পে ফিরে আসার পর হঠাৎ একদিন দেখি, ভারতীয় পোস্টকার্ডে লেখা বাদল ভাইয়ের চিঠি। চিঠির মর্ম এই, ‘মুস্তাফা মনোয়ার বলেছেন, শিগগিরই এখানে চলে এস।’ আমেরিকা থেকে একজন ক্যামেরাম্যান এসেছেন, ছবি করবেন। আমি সেখানে কিছু কাজ করেছি। (লেয়ার লেভিনের কথা হচ্ছে। তখনো আমি তাঁর নাম জানতাম না। তাঁরই তোলা ফুটেজ নিয়ে পরে মুক্তির গান ছবিটি হয়েছে।) এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা দরকার। বাদল ভাই সংগঠক হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তা আরও ভালোভাবে জানতে পেরেছি। সংস্কৃতিমনা মানুষদের কে কোথায় আছেন, তা তিনি জানতেন। যখনই যাকে প্রয়োজন হতো, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন।
এরপর দেশ স্বাধীন হয়। আমরা ফিরে আসি মুক্ত বাংলায়। ডিআইটি ভবনের উল্টো দিকে স্টেডিয়ামের প্রভিন্সিয়াল রেস্টুরেন্টে তখন আল মনসুর, রিয়াজউদ্দিন বাদশা, আলী ইমাম, আমিসহ অনেকেই আড্ডা দিতাম। বাদল ভাইও মাঝেমধ্যে সেই আড্ডায় যোগ দিতেন। তিনিই ওখানে এসে একদিন বললেন, ‘শোন, পুনায় যেতে হবে কিন্তু, প্রস্তুতি নে।’
আমরা তখন পুনা কী, তার কিছুই জানি না। বাদল ভাই বুঝিয়ে বললেন, ভারতের পুনায় চলচ্চিত্রের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়া যায়। বাদল ভাই-ই পুনায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার বীজটি বপন করলেন আমার মধ্যে। সে বছর সালাউদ্দিন জাকী ভাই আর বাদল ভাই গেলেন পুনায়। তিনি আমার মনে জেদ ধরিয়ে দিলেন। পরের বছর আমি আর আনোয়ার হোসেন আবেদন করলাম। আমি চেয়েছিলাম চলচ্চিত্র পরিচালনায় প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্তু আমার হলো সম্পাদনায়। তাই আমি যেতে চাইনি। সেই বাদল ভাই আমাকে বোঝালেন, সম্পাদনার কাজটি ভালো। সম্পাদনার ওপর পড়ে এসেও ছবি পরিচালনা করা যায়। তিনি নিজেও পড়ছিলেন সম্পাদনা নিয়ে। বাদল ভাই, জাকী ভাই বললেন, ‘এখনই সিদ্ধান্ত নিও না। আগে পুনায় আসো, দেখ, ভালো লাগলে থেকে যাও।’ তাঁদেরই কথার ওপর ভর করে পুনায় গেলাম। সেখানে তাঁদের অভিভাবকত্বেই ছিলাম। প্রথম বছর তো তাঁরাই কী করতে হবে, তা দেখিয়ে দিয়েছেন। ঠিক করে দিয়েছেন পড়াশোনার বিষয়, ছবি দেখার বিষয়টিও।
দেশে ফেরার পর বাদল ভাইও সম্পাদক, আমিও সম্পাদক। দুজনের ভেতর যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, তেমনি ছিল আন্তরিক সৌহার্দ্য। বাদল ভাই ঠিক করে দিয়েছেন, কোথায় কীভাবে কাজ করব। ডিএফপিতে আলমগীর কবির ও সালাউদ্দিন জাকীর ছবি সম্পাদনা করেছি আমি। বাদল ভাই-ই সে সুযোগ করে দিয়েছেন আমাকে।
এ তো গেল ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা। এবার মানুষ বাদল ভাইকে নিয়ে কিছু কথা বলি। তিনি ছিলেন বিপ্লবী মানুষ। যেখানেই অন্যায় দেখেছেন, সেখানেই দেখেছি তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন।
বাদল ভাইয়ের ছিল ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভের স্বপ্ন। তিনি ভাবতেন, সবাই তো আর স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশোনা করে আসতে পারবে না, তাই দেশের মধ্যেই একটি ইনস্টিটিউট হোক, যেখান থেকে মেধাবী তরুণেরা চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে। আমাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অ্যান্ড আর্কাইভ আলমগীর কবির, বাদল রহমান, সালাউদ্দিন জাকীদেরই অবদান। বাদল ভাই বললেন, শুধু ইনস্টিটিউট হলেই হবে না, এখানে পড়াতেও হবে। তাঁরই অনুপ্রেরণায় আমরা সেখানে ক্লাস নিয়েছি, পড়িয়েছি।
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে বাদল ভাইয়ের রয়েছে অসামান্য অবদান। বিভিন্ন চলচ্চিত্র ক্লাব গঠনে ছিল তাঁর উত্সাহ। ভালো ছবি দেখে আমাদের তরুণেরা ভালো ছবি বানাতে শিখুক, সেটাই তিনি চাইতেন। ১৯৮০ সালে সরকার চলচ্চিত্র সংসদ আইন করে এই আন্দোলনকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। এই আইন বাতিলের জন্য যুদ্ধ করেছেন বাদল ভাই। এই আইন থাকলে ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হবে না, এ দেশে ভালো দর্শক তৈরি হবে না—এটা তিনি বুঝতেন। বর্তমান সরকার এই আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু তা এখনো ঝুলে আছে। একটা কথা বুঝতে পারি না, এখন তো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবই উন্মুক্ত, তাই চলচ্চিত্র বিষয়ে এ রকম একটি আইন থাকার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি?
লেখার শেষে আমি সরকারের কাছে একটি আবেদন রাখব। বাদল ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই চলচ্চিত্র সংসদ আইন বাতিল করুন। যদি পুরো বাতিল করা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত আইনে সংশোধন আনুন, যেন মুক্ত হাওয়া ছড়িয়ে দেওয়া যায় সর্বত্র।

No comments

Powered by Blogger.