জনকের জন্মদিনে by মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

নিকট-অতীত সাক্ষ্য, কেমন কালো শক্তি গ্রাস করে নিয়েছিল শুভ সমস্ত কিছুকে। সেই শক্তি প্রাসাদ ছাউনিতে ষড়যন্ত্রের আর কেমন জোট বাঁধা হয়ে গিয়েছিল পিছুটান প্রতিক্রিয়াশীলতার সঙ্গে; আরেক জোট ঘরভেদী বিভীষণের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি। সবটা মিলিয়ে ওই দুঃসময়। এবং প্রতিরোধে আমাদের নিষ্ক্রিয়তাই বলি,


কি ব্যর্থতাই বলি, দায়ভার এড়িয়ে যাবে কারা সেইজন, সেই কর্ম আত্মপ্রতারণার অপরাধের শামিল। বলা গেছে, কালো শক্তি গ্রাস করে নিয়েছিল মানবকল্যাণের সমস্ত কিছু। কী বোঝায় 'সমস্ত কিছু' কথাটা দিয়ে? এই তো সেদিনের ইতিহাস_বাংলাদেশের মানুষের জন্য মুক্তিযুদ্ধের তাবৎ অর্জন। স্পষ্ট জবাবে তা-ই তো বুঝে থাকি। সেইখানে_(ক) মাতৃভূমি দেশচেতনা, (খ) দূর অতীতাবধি বহমান বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য চেতনা, (গ) মানুষের মৌল অধিকার এবং (ঘ) সমুদয় মাত্রিকতায় বাঙালিত্বের আইডেনটিটি। এখন একই সঙ্গে যোগ করে নিতে হবে সেই তাঁকে, যিনি সূর্য প্রেরণার উৎস, প্রাণিত করে গেছেন এতদঞ্চলের সাত কোটি মানুষকে। ১৯৭১-এর দলিল, আন্তর্জাতিক বিশ্বে জন্ম নিল সার্বভৌম এক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ; 'বাঙালি' অভিধায় এক নতুন 'নেশন'। আমরা তো প্রত্যক্ষ করলাম, নেতা তিনি শেখ মুজিব আর ব্যক্তি মানুষটি মাত্র নন, দেশবাসীর হৃদয়ে কখন আসীন হয়ে গেছেন 'জনক' প্রতীকে। স্বাভাবিক যে, এমত ক্ষেত্রে আবেগ কাজ করে থাকে। তবে অধিকতর সত্য_সেইখানে ইতিহাসের নির্মাণ। প্রসঙ্গত অবশ্য করে জানা যে, এই শতকেই অনুরূপ আতাতুর্ক, বাপুজি, আংকল হো কিংবা বাং কার্নো_আপন আপন দেশে এঁরা উক্ত প্রকারের প্রতীক-প্রতিভূ।
পূর্ব কথনের জের টেনে বলি, বাংলাদেশের মানুষের জন্য সে এক দুঃসময়ের কালপর্ব গেছে। তখন বায়ু বিষাক্ত, আলো নির্বাপিত। মার খেয়ে যাচ্ছিল অর্জনের একাত্তর। অন্ধকারের গুহা থেকে ওরা বেরিয়ে এসেছিল। কারা ওরা? ইতিপূর্বে খানিকটা আভাস দেওয়া গেছে। সচেতন জন অবশ্য স্পষ্টতর করে নির্দেশ করবেন, ওরা '৪৮-৭১-এর দুশমন শক্তি : বাংলাদেশ-বাঙালিত্বে যাদের বিশ্বাস নেই, পাকিস্তানিত্বের লেজুড়বৃত্তিতেই যাদের তরক্কি বিবেচনা, তারা মুসলিম লীগ ইসলামপছন্দ দলগুলোর তল্পিবাহক, তারা সাম্প্রদায়িকতার নিশানবরদার এবং আগ্রাসী পাকিস্তানের পক্ষে কোলাবরেটর ঘাতক। '৭৫-এর আগস্টোত্তর গ্রহণের কালে পরিকল্পিত মতলবে সংবিধান খণ্ডিত করে দেওয়া হলো; সেই সাথে ইতিহাসের বিকৃতি আর জনকের নির্বাসন, জনককে বিস্মৃত করিয়ে দেওয়া। সাধারণ মানুষ আমরা ত্রস্ত বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। এখন সংকট যে, বংশধর ঘরের সন্তান দুই দশককাল ধরে বিকার-বিভ্রান্তির পরিবেশে লালিত হয়ে উঠেছে। ফলে জানা নেই তাদের হাজার বছরের বাংলার মহত্তম উত্তরাধিকারের অবয়বটি কী প্রকারের, জানা নেই জনকের সন্ধান।
আজ ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিন। মেলা-ই অনুষ্ঠান হবে; স্বাভাবিক যে, আবেগ থাকবে, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থাকবে, হয়তো বা রুটিন-মানা কাণ্ডেরও অভাব ঘটবে না। তবে বিবেচনা করি, দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে অবকাশ এসেছে_নষ্ট করে দেওয়া, হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু সম্পদ ঐশ্বর্যকে উদ্ধারের প্রয়াসে যেন উদ্যোগী হয়ে উঠি। এ কি কেবলই শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু নাম-পরিচিতির মানুষটির জন্মদিন? আক্ষরিক শব্দার্থ এক প্রকারের। তবে বাংলাদেশ-সড়কে অভিযাত্রী যাঁরা, তাঁরা জানেন, কথাটির ব্যঞ্জনা কত গভীরে, বহন করে কী মহৎ ইতিহাস। সেইখানে বাংলা নামে দেশ।
শতাব্দীর অবসান-প্রান্ত সীমানায় পেঁৗছে দেখতে চাইছি, ৯ দশকেরও বেশি হয়ে এল ওই দিনটি, মার্চ ১৭, সাল ১৯২০_কোনো এক শেখ পরিবারে এক শিশুর জন্ম। ঠিকানা দক্ষিণ বাংলার কোনো এক টুঙ্গিপাড়ায়। প্রকৃতির রাজ্যে জন্ম-মৃত্যু_এ তো নিত্যকার ঘটনা। পরিবারের বাইরে ক'জনায় সেই খোঁজ রাখে? কে জানত, তখন অলক্ষ্যে নিয়তির লেখনকথা_অজগাঁয়ের নবজাতক এই শিশুই পরের কালে হয়ে উঠবে ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল প্রতিভূ। চিহ্নিত সেসব বিরল মানুষের জীবনকাহিনী আমরা পাঠ করব এবং জেনে যাব, এখনই যেন বা বিধির বিধান। তবে লক্ষ করার যে, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মান না তাঁরা। আবার এমনও নয়, 'এক সুপ্রভাতে আমি জেগে উঠলাম; এবং দেখলাম, আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেছি।' তদর্থে মোটে নন তাঁরা ভাগ্যদেবতার বরপুত্র।
এখন বলি, অখ্যাত এক জনপদ বাসিন্দা 'সাধারণ ঘরের কোনো এক জাতক মাত্র, অবশ্য তা নয়, শেখ মুজিব যে শেষাবধি শতাব্দীর অন্যতম মহৎ সন্তান_আমাদের গুরুত্ব আরোপ সেইখানে।' কাছের মানুষেরা, সহযাত্রীরা বিশেষ করেই জানেন তা। ওই সড়ক নানান বিচিত্রমুখী ঝঞ্ঝায় বিক্ষুব্ধ, সংকটসংকুল। দেশ-কাল-জনমানুষসম্পৃক্ত পটভূমিতে তাঁর জীবনপরিক্রমা আমরা অনুসরণ করে যাব; আর ইতিকথার অধ্যায়গুলো উন্মোচিত হতে থাকবে। চলি্লশের দশকে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের কাল; পরের পর্যায়ের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-জুলুম শাহির দাপট, আগ্রাসন; বাংলার মানুষ হটেনি, মারের সাগর পাড়ি দিয়ে তবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। টুঙ্গিপাড়ার ওই ছেলেটি কখন মিশে গেছেন সমগ্রের আত্মার সঙ্গে। এইবার; এমন করে জানাই যে, সমকালের আমরাই প্রত্যক্ষ করেছি, একদার শেখ মুজিব, মুজিব ভাই '৬৯ নাগাদ গণঅভ্যুত্থানের জাতক 'বঙ্গবন্ধু' এবং অতঃপর বছর দুয়েকের মাথায় যখন 'বাংলা' নামে দেশের সৃজন, ইতিমধ্যে ওই সত্তা 'জনক' অভিষিক্ত।
তেমন নিদর্শন আর কী রয়েছে_মাতৃভাষার ইজ্জত প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে প্রতিরোধী আন্দোলনের যাত্রা শুরু, আর শেষ সীমান্তে পেঁৗছে অর্জন স্বাধীন-সার্বভৌম 'নেশন স্টেট'। এতদঞ্চলের কোটি মানুষের শ্রমে-স্বেদে-রক্তে এবং শপথ আদর্শের জোরে ব্যতিক্রমী সেই সত্যটিকেই বাস্তবে সম্ভব করা গেছে। এইখানে বাংলাদেশ-অভিযানের দুই যুগের ইতিহাস নির্মাণে তাঁর ভূমিকা অবলোকন করব। সে তো '৪৮-এ ভাষা আন্দোলনের উদ্বোধন থেকেই। পার্টিশনের দরুন কলকাতার পাট চুকিয়ে দিয়ে ঢাকায় আসা শেখ মুজিব তখন ছাত্রনেতা। আর '৫৪ নাগাদ যখন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনাধিকারের দাবিতে আন্দোলন-নির্বাচন, তত দিনে তিনি সার্বক্ষণিক রাজনীতির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন এবং নির্বাচনী যুক্তফ্রন্টের সংগঠক নেতা। প্রাসঙ্গিক লক্ষ করব, মুসলিম লীগবিরোধী ফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের ২১ দফার প্রথম দফাই হচ্ছে_'বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।' মাতৃভাষার দাবি আর স্বাধিকারের দাবি দুটো কেমন এক স্রোতোধারায় মিশে গেছে।
আজকের বিশেষ দিবসটিকে অবলম্বন করে আমরা দেখার প্রয়াস পাচ্ছি, বাঙালির বাঁচার দাবি 'ছয় দফা'র রূপকার দ্রুত কেমন দেশময় সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছেন। আমরা দেখছি সেইখানে বাংলার মুখ। প্রস্তাবনায় এমত করে বলা গিয়েছিল_জনককে আমরা চিনে নেওয়ার প্রয়াস পাব। সন্তানের জন্য এটি ফরজ কর্ম। এখন তবে তাঁর আপন উক্তি থেকেই উদ্ধৃত করতে চাইছি, 'ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।' আর ব্যাখ্যা-বয়ানের প্রয়োজন দেখি না। অতঃপর সৎ-সুস্থ বাঙালি মাত্রেই জেনে যাবেন, চিনে নেবেন। জাতির জনকের জন্মদিনে পুনর্বার তাকাই ইতিহাসের দিকে।
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.