ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা-উপজেলার মতো জেলায়ও একই সমস্যা দেখা দেবে

উপজেলার কাজ কী হবে, রাজস্ব আয়ের উৎস কী হবে, উপজেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা থাকবে কি না, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বেতন ও পদমর্যাদা কী হবে, উপজেলার সঙ্গে অন্যান্য স্থানীয় ইউনিটের (ইউনিয়ন, পৌরসভা, জেলা, নগর করপোরেশন ও বিভাগ) সম্পর্ক ও সমন্বয় কী ধরনের হবে, কেন্দ্রীয় সরকারের


কর্মকর্তাদের (নির্বাচিত-অনির্বাচিত) সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে, উপজেলা কোন প্রকারের স্থানীয় ইউনিট ও স্থানীয় সরকার হবে, মধ্যবর্তী স্থানীয় ইউনিট হিসেবে উপজেলার গুরুত্ব কতটুকু ইত্যাদি বিবেচনায় না নিয়ে, প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন না করে উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। নির্বাচনে পদপ্রার্থীরাও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। এমনকি যাঁরা স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত, তাঁরা তো এ বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি। আবার অনেক এনজিও উপজেলা নির্বাচনের দাবিতে সভা-সেমিনার করে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত টাকা খরচেই ব্যস্ত ছিল। আর এনজিওগুলোর এসব সভা-সেমিনারে সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি এবং আলোচক হয়ে অনেক পরিচিত ব্যক্তিত্ব তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। এবং সর্বোপরি বলা যায়, ভোটাররাও এসব বিষয় জানার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। ফলে বারবার আইন সংশোধন এবং বিধিমালা প্রণয়ন করেও সরকার উপজেলা ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে ব্যর্থ হচ্ছে। একইভাবে সরকার জেলা সম্পর্কে পদ্ধতিগত ও গুণগত পরিবর্তন না এনে এবং ভালোভাবে চিন্তাভাবনা ও একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাস গ্রহণ না করে একটি বিল জাতীয় সংসদে পাস করে জেলা পরিষদ নির্বাচন দিতে চাইছে বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে ভবিষ্যতে উপজেলার মতো জেলায়ও একই ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। সে জন্য দুই ধরনের সরকার (কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার) ব্যবস্থার অধীনে স্থানীয় সরকার গবেষক ও সিডিএলজির নির্বাহী পরিচালক আবু তালেব প্রণীত স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাসটি গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী গ্রামোন্নয়ন ও সেবামূলক কাজ গ্রামীণ স্থানীয় সরকারকে, নগর উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজ নগরীয় স্থানীয় সরকারকে এবং গ্রাম-নগর উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজ গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকারকে দিতে হবে।
গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ঐক্য পরিষদ ১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরণ অনশন শুরু করে। তাঁদের এই দাবির প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু এবং ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননসহ কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী একাত্মতা ঘোষণা করেন। পরদিন ২৩ জানুয়ারি দুই এমপি রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুর অনুরোধে তাঁরা অনশন ভঙ্গ এবং ২৮ মার্চ পর্যন্ত তাঁদের সব ধরনের কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, 'সরকার উপজেলার জন্য যে আইন করেছে, তা সংশোধনের কারণে বিকৃত রূপ পেয়েছে। এতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যে অবস্থান, তা অসম্মানজনক। অপরদিকে হাসানুল হক ইনু বলেন, 'অনির্বাচিত ইউএনওদের হাত থেকে জনপ্রতিনিধিদের মুক্ত করতে হবে। আইনে জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার বিধান করে তাঁদের অসম্মান করা হয়েছে।' (প্রথম আলো, ২৪ জানুয়ারি ২০১১)। সবাই জানেন, জেনারেল এরশাদ উপজেলা সৃষ্টি করেছিলেন অবৈধ ক্ষমতা প্রলম্বিত ও পোক্ত করার জন্য এবং তা কোনো মানদণ্ডেই স্বশাসিত-স্বাবলম্বী উপজেলা ছিল না। বর্তমানেও উপজেলাকে স্বশাসিত ও স্বাবলম্বী করার কোনো রূপরেখা তঁাঁর নেই; এবং তাঁর দলের সংসদ সদস্যরা বিদ্যমান দুর্বল উপজেলা আইন পাসে দুই হাত তুলে সংসদে সমর্থন দিয়েছেন। আর সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু এবং রাশেদ খান মেনন এই উপজেলা ও গোটা স্থানীয় সরকারব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নে তাঁদের পরিকল্পনা প্রকাশ করলে আলোচনার জন্য খুব সুবিধা হবে বলে আমরা মনে করি। আমরণ অনশন চলাকালে অনশনকারীরা একটি দাবি খুব জোর দিয়েই উপস্থাপন করেছিলেন। আর তা হলো_সম্মানী ভাতা তথা বেতন বৃদ্ধিবিষয়ক দাবি (যদিও তাঁদের ১০ দফার মধ্যে এটা ছিল না)। এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য হলো_উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে যে সম্মানী ভাতা (প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা) দেওয়া হয়, তা পৌরসভার মেয়রের চেয়েও কম। বর্তমানে প্রথম শ্রেণীর পৌরসভার মেয়রকে সম্মানী দেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার, দ্বিতীয় শ্রেণীর পৌরসভার মেয়রকে ১৫ হাজার এবং তৃতীয় শ্রেণীর পৌরসভার মেয়রকে ১২ হাজার টাকা। বিভিন্ন বক্তা এটাকে অপমানজনক হিসেবে উল্লেখ করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁদের এই সম্মানী ভাতার বিষয়ে হারুন-উর-রশিদ হাওলাদার এবং বদিউজ্জামান বাদশার নেতৃত্বাধীন উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদ গ্রুপটিরও সমর্থন রয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ বিষয়টি বুঝতে উভয় গ্রুপের এত দিন লাগল কেন? তাঁরা তো নির্বাচনের পর পরই সিডিএলজির পক্ষ থেকে ২৫ দফা সুপারিশ পেয়েছিলেন। এই সমস্যাসহ আরো অনেক সমস্যা এবং তার সমাধান সূত্র ২৫ দফায় রয়েছে। সেসব বিষয়ে উভয় গ্রুপ কি নজর দেবে? নাকি আন্দোলনটা অন্যসব পেশাগত আন্দোলনের মতো কেবলই সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির আন্দোলনে রূপ নিতে যাচ্ছে? ইতিমধ্যে উপজেলার নিজস্ব আয়ে যেখানে একটি বাইসাইকেল কেনার সামর্থ্য নেই, সেখানে ৪৩ লাখ টাকার গাড়ি প্রাপ্তি এবং তার জন্য প্রতিদিনকার খরচ নিয়ে জনমনে নানা রকম প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে স্থানীয় উন্নয়নই হলো প্রকৃত উন্নয়ন। কিন্তু তার আগে দুই ধরনের সরকারব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থার অধীনে ইউনিয়নে 'ইউনিয়ন সরকার', উপজেলায় 'উপজেলা সরকার', জেলায় 'জেলা সরকার', বিভাগে 'বিভাগীয় সরকার' (যদি বিভাগ প্রয়োজনীয় হয়) এবং নগরে (পৌরসভা ও নগর করপোরেশন) একরূপ 'নগর সরকার' বাস্তবায়ন করতে হবে। সে জন্য সরকারের স্তরবিন্যাসকরণ জরুরি। এ বিষয়ে গণতন্ত্রায়ন ও স্থানীয় সরকার গবেষক আবু তালেব প্রণীত 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা' শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থটি বিশেষভাবে অনুসরণীয়। বর্তমানে ৪৮২টির মধ্যে ১৭৪টি উপজেলা শুধু ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হওয়ায় এগুলো গ্রামীণ স্থানীয় সরকার এবং বাকি ৩০৮টি উপজেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা ও ইউনিয়ন থাকায় এগুলো গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার হওয়ার কথা। অথচ বলা হচ্ছে, এগুলোও গ্রামীণ স্থানীয় সরকার। যদি উপজেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভাকে রেখে দেওয়াকে যৌক্তিক মনে করা হয়, তাহলে পৌরসভার মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাজ দিতে হবে এবং পৌরসভাকে উপজেলার অধীনস্থ করতে হবে। কিন্তু এটা সম্ভব না হওয়ায় উপজেলার আয়তনের মধ্য থেকে পৌরসভাগুলোকে বাদ দেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। এবং তা করা হলে মেয়রদের সঙ্গে বেতন ও পদমর্যাদা নিয়ে চেয়ারম্যানের বিরোধ হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। আবার প্রতিটি জেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা ও নগর করপোরেশন থাকায় জেলা পরিষদও গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার হওয়ার কথা। অথচ জেলাকে শুধু গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিট মনে করে জেলা পরিষদকে গ্রামীণ স্থানীয় সরকার হিসেবে গণ্য করা হয়। এটা মারাত্মক ভুল ধারণা। এর সংশোধন অবশ্যই প্রয়োজন। আবার উপজেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা রেখে দেওয়ায় উপজেলা চেয়ারম্যানরা যেমনিভাবে তাঁদের বেতন-ভাতা মেয়রের চেয়ে বেশি দাবি করছেন, তেমনিভাবে জেলার আয়তনের মধ্যে নগর করপোরেশনগুলো থাকায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরাও নগর করপোরেশনের মেয়রের চেয়ে বেশি বেতন-ভাতা ও পদমর্যাদা দাবি করবেন। এটাই স্বাভাবিক। তখন কি সরকার তাদের মন্ত্রীর পদমর্যাদার চেয়েও বেশি বেতন ও পদমর্যাদা দিয়ে সিনিয়র মন্ত্রীর পদমর্যাদার পদ সৃষ্টি করবে? সে জন্য স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট, মধ্যবর্তী ইউনিট ও সর্বোচ্চ ইউনিট ঠিক করে স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাসকরণ ও প্রকারভেদকরণ খুবই জরুরি।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় উন্নয়নের জন্য যেসব আদেশ-নির্দেশ ও পরিপত্র জারি করে, তা প্রস্তুত করে থাকে সচিবালয়। সচিবালয় থেকে সব চিঠিপত্র প্রথমে আসে জেলাগুলোতে। অর্থাৎ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দূরবর্তী অবস্থানে থেকে স্থানীয় সেবা এবং উন্নয়ন চিন্তা করে থাকেন। ফলে পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে তাঁদের অনেকেই জীবনবিমুখ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। সে জন্য তৃণমূলকেন্দ্রিক জীবনমুখী সেবা ও উন্নয়ন সংস্কৃতি নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাকরণ (প্রস্তাবিত স্তরবিন্যাসকরণ-১ অথবা ২) গ্রহণ করে জেলা সরকারের রূপরেখাটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তাই গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় উপস্থাপিত 'জেলা সরকারের রূপরেখা'র কপি সিডিএলজির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে সরকারের বিভিন্ন স্তরে পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে। এই জেলা সরকার তিনটি বিভাগ তথা জেলা প্রশাসন, জেলা সংসদ ও জেলা আদালত নিয়ে গঠিত হবে। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে 'জেলায় জেলায় গণতন্ত্রায়ন, জেলার জনগণের ক্ষমতায়ন' নীতি বাস্তবায়ন শুরু হবে।

লেখকবৃন্দ : প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ডিরেক্টর-ইন-চার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢাবি; ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস শিক্ষা এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি।

No comments

Powered by Blogger.