বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪০৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। এ কে মাহবুবুল আলম, বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা সফল যোদ্ধা ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস। তখন রাজশাহীর দক্ষিণাঞ্চল চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশির ভাগ বন্যাকবলিত। পদ্মা নদীর দুই কূল ভেসে গেছে। যেদিকে চোখ যায়, মনে হয় সাগর।


মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে দু-একটি গ্রাম।
১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। ভারতে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে খবর গেল, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাকিস্তানিরা জাঁকজমকপূর্ণভাবে তা উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওই এলাকা মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাবসেক্টরের আওতাধীন। সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন (বীর বিক্রম, পরে ব্রিগেডিয়ার) সিদ্ধান্ত নিলেন, ওই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জে বড় ধরনের একটি অপারেশনের।
শুরু হলো প্রস্তুতি। এই অপারেশনের জন্য মনোনীত করা হলো এ কে মাহবুবুল আলমসহ ৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে, যাঁদের প্রত্যেকের চোখে জিঘাংসা আর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের চিহ্ন। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দলে বিভক্ত করা হলো। প্রথম গ্রুপে ২০ জন। দ্বিতীয় গ্রুপে ৩৫ জন। তৃতীয় গ্রুপে ৩১ জন।
দ্বিতীয় গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হলেন এ কে মাহবুবুল আলম। তাঁদের ওপর দায়িত্ব হরিপুর সেতুতে আক্রমণ করা। সেখানে প্রহরারত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীদের হত্যা বা বন্দী করে সেতু উড়িয়ে দেওয়া, যাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীর একমাত্র সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এ কে মাহবুবুল আলমসহ ৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধা কয়েকটি নৌকায় ভারত থেকে সকালে রওনা হলেন টার্গেটের উদ্দেশে। সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছালেন টার্গেটের দুই মাইল দূরত্বে। এর মধ্যে কেটে গেছে আট-নয় ঘণ্টা। বাকি দুই মাইল পথ বেশ বন্ধুর। কারণ, ওই দুই মাইল এলাকায় আছে পাকিস্তানিদের অসংখ্য সহযোগী ও অনুচর।
রাত নয়টায় দ্বিতীয় গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা অতি সন্তর্পণে কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়াই শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হলেন হরিপুর সেতুর কাছে। সেদিন আকাশে চাঁদ ছিল না। তবে তারকারাশির মিটমিট আলো পানিতে পড়ে চারদিক কিছুটা আলোকিত করে রেখেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো শব্দ না করে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ১০০ গজের মধ্যে যাওয়া মাত্র শত্রুর দিক থেকে আওয়াজ এল ‘হল্ট’ ‘হ্যান্ডস আপ’। এ কথা শেষ না হতেই গুলি শুরু হলো।
মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করলেন। শুরু হলো তুমুল লড়াই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেতুর দখল চলে এল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। সেদিন যুদ্ধে এ কে মাহবুবুল আলমসহ কয়েকজন যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁদের আক্রমণে নিহত হয় দুই পাকিস্তানি সেনা। দুজন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে যায়। আহত একজনসহ ১১ জন পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী জীবন্ত ধরা পড়ে।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা এক্সপ্লোসিভ লাগাতে শুরু করলেন সেতুতে। রাত আনুমানিক ১২টা পাঁচ মিনিট। গগনবিদারী আওয়াজে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এই সঙ্গে আশপাশের গ্রামের মানুষ ঘুম থেকে চিৎকার করে ভাবতে থাকল কেয়ামত এল বুঝি। নিমেষে ধ্বংস হয়ে গেল সেতু।
এ কে মাহবুবুল আলম ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৭ নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাবসেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এ কে মাহবুবুল আলমকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৬৪। গেজেটে নাম এ কে এম মাহবুবুর রহমান। ২০০৪ সালে নাম সংশোধন করা হয়।
এ কে মাহবুবুল আলম স্বাধীনতার পর সরকারি চাকরি করেন। বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানার (রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা) হেতেম খানে (ই-৩, ক্যাপ্টেন শামসুল হক খান সড়ক)। বর্তমানে বাস করেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম মুলতান উদ্দিন আহমেদ। মা নূর মহল খাতুন। এ কে মাহবুবুল আলম চিরকুমার।
সূত্র: ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র। দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.