তাঁদের ঘুম আর ভাঙেনি-বাহরাইনে ১০ বাংলাদেশির মৃত্যু

দেশের মাটি ছেড়ে ওঁরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে ছিলেন কেবল পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাতে। সবাইকে ভালোভাবে রাখতে নিজেরা খেটে মরতেন উদয়াস্ত। তার পরও ঘুমাতে যেতেন এই আনন্দ বুকে নিয়ে যে, এই শ্রমের বিনিময়ে ফেলে আসা স্বদেশে বাবা-মা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা কিছুটা হলেও সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারছে।


গত শনিবার রাতেও এ রকম ভাবতে ভাবতেই হয়তো একসময় ঘুমের রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেই ঘুম আর ভাঙেনি। গতকাল রবিবার ভোরে আগুনের
ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাহরাইন প্রবাসী ১০ বাংলাদেশি শ্রমিক। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাহরাইনের রাজধানী মানামা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে রিফা এলাকায় এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতদের সবাই বৃহত্তর কুমিল্লার অধিবাসী এবং তাঁদের কয়েকজন পরস্পরের আত্মীয় বলে জানা গেছে। সুদূর বাহরাইন থেকে গতকাল এ দুঃসংবাদ দেশে আসার পর নিহতদের গ্রামগুলোতে মাতম শুরু হয়।
জানা গেছে, বাহরাইনের ওই এলাকার একটি ঘরে ১১ জন বাংলাদেশি একসঙ্গে থাকতেন। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে সৃষ্ট আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে তাঁদের মধ্যে ১০ জনই মারা যান। বেঁচে আছেন শুধু একজন। নিহতদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের সদস্য। সূত্র আরো জানায়, দুর্ঘটনার পরপরই নিহতদের সবার নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয় যে তাঁরা বৈধভাবেই বাহরাইন এসেছিলেন। আরো যাচাই-বাছাইয়ের পর নিহতদের নাম-পরিচয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। বাহরাইনের পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা নাগাদ নিহত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন : কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার ভূশ্চি ইউনিয়নের মগের কলামিয়া গ্রামের মোহাম্মদ হানিফ মিয়া (৪৮), তাঁর শ্যালক লাকসাম উপজেলার যশপুর গ্রামের খোরশেদ আলম (৪০) ও মেয়ের জামাই কুমিল্লার সদর দক্ষিণের জামিরা গ্রামের মনির হোসেন (৩২), লাকসাম উপজেলার মোহনপুর-চানপুর গ্রামের শাহালম ওরফে নুরুল ইসলাম (৪৫), লাকসামের উত্তরদা গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৪০), কুমিল্লা সদর দক্ষিণের ভূশ্চি পূর্বপাড়ার সিদ্দিকুর রহমান (৩৫), সুসণ্ডা গ্রামের আবু তাহের (৩৮), চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আবুল হোসেন (৩৫) ও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ফরিদগঞ্জের সৈয়দ আহমেদ (৪৫)।
পাত্রপক্ষ আসার আগেই এলো
মেয়ের বাবার মৃত্যু সংবাদ
লাকি আক্তারকে গতকাল দেখতে আসার কথা ছিল পাত্রপক্ষের। সে জন্য সকাল থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাঁর পরিবার। কিন্তু এমন সময় বাহরাইন থেকে ফোন এলো। জানানো হলো, লাকির বাবা হানিফ মিয়া বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে লাগা আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। সেই সঙ্গে মারা গেছেন তাঁর শ্যালক খোরশেদ আলম, বড় মেয়ের জামাই মনির হোসেন। পুরো পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। আর নিজের ভাগ্য, বাবার মৃত্যু ও পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে লাকি কিছুক্ষণ পরপরই বিলাপ করে ওঠেন, আবার জ্ঞান হারান। তাঁর এ অবস্থা দেখে প্রতিবেশীদেরও চোখ ভিজে যায়।
নিহত হানিফ মিয়ার বাবার নাম আবদুল জাব্বার। হানিফ মিয়ার শ্যালক খোরশেদ আলমের বাবার নাম লাল মিয়া। মেয়ের জামাই মনির হোসেনের বাবার নাম কাশেম মিয়া।
হানিফ মিয়ার ছোট ভাই নুরুল ইসলাম জানান, ১০ বছর রিকশা চালিয়ে ধারদেনা করে তাঁর ভাই বাহরাইনে গিয়েছিলেন ভাগ্য ফেরাতে। ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় পাঁচ মেয়ে এবং এক ছেলের জীবনে শোকের পাশাপাশি চরম অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে। নুরুল ইসলাম জানান, গতকাল সকাল ৭টায় বাহরাইন থেকে এক ব্যক্তি ফোনে তাঁকে বলেছেন তাঁর বড় ভাই হানিফ মিয়া মারা গেছেন। যাঁরা মারা গেছেন তাঁরা সবাই একই কক্ষে ঘুমন্ত অবস্থায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন।
নুরুল ইসলাম জানান, ওই কক্ষের গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে যাওয়ার কারণে বদ্ধ ঘরে গ্যাস জমে দম বন্ধ হয়ে তাঁদের মৃত্যু হয় বলে টেলিফোনে ওই ব্যক্তি তাঁকে জানিয়েছেন।
হানিফ মিয়া গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাহরাইনে আছেন। যাওয়ার পর আর দেশে ফিরে আসেননি। তৃতীয় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে আগামী রমজান মাসে তাঁর বাড়ি আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই লাশ হয়ে ফিরছেন তিনি। এই দুঃখ যেন তাঁর পরিবারকে পাথর করে দিয়েছে। পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের জনক হানিফ মিয়া তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। একমাত্র ছেলে বিল্লাল হোসেন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। বিল্লালের জন্মের সময় হানিফ মিয়া বাহরাইনে চলে যান। ফলে ছেলের মুখ দেখতে পারেননি তিনি। পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারেননি এখনো। দোচালা টিনের ঘরেই তাঁদের বসবাস।
হানিফ মিয়ার মেয়ে লাভলি আক্তার জানান, গতকাল তাঁর বড় বোন লাকিকে পাত্রপক্ষের দেখতে আসার কথা ছিল। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে তারা আর আসেনি।
হানিফ মিয়ার জামাতা মনির হোসেন বাহরাইনে যান তিন বছর আগে। শ্বশুরের সহযোগিতায় গিয়ে শ্বশুরের কাছেই ওঠেন তিনি। এক ছেলে এক মেয়ে তাঁর। ছেলের বয়স সাত বছর আর মেয়ের তিন বছর। খোরশেদ আলমও যান তিন বছর আগে। তিনিও ওঠেন ভগি্নপতির কাছে। তাঁর দুই ছেলে। বড়টির বয়স সাত বছর আর ছোটটির পাঁচ বছর। তাঁর বাবার নাম লাল মিয়া। তিনজনই তাঁদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্বজনরা এখন তাঁদের লাশ কবে দেশে আসবে, সেই অপেক্ষায় রয়েছে।
কুমিল্লার সদর দক্ষিণের ভূশ্চি পূর্বপাড়ার ছিদ্দিকুর রহমানের বাবা কৃষক আনোয়ার উল্ল্যাহ জানান, তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ছিদ্দিকুর রহমান সবার বড়। বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্ট দূর করার আশা নিয়ে ছিদ্দিকুর মাত্র চার মাস আগে বাহরাইনে গিয়েছিলেন। ছেলের বিদেশ যাওয়ার ধারদেনা পরিশোধ হয়নি এখনো। এর মধ্যেই ছেলে হারানোর খবর তাঁকে নির্বাক করে দিয়েছে।
কর্মসংস্থান ও জনশক্তি ব্যুরোর মহাপরিচালক শামসুন্নাহার জানান, ঘটনার তদন্ত এবং সে দেশের আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে লাশ আসতে আরো দু-তিন দিন সময় লাগবে। শামসুন্নাহার আরো জানান, নিহতদের লাশ সালমানিয়া মেডিক্যাল কমপ্লেঙ্রে মরচ্যুয়ারিতে রাখা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছে। তিনি আরো বলেন, নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ তালিকা পরে জানানো হবে। নিহতরা যে কক্ষে ছিলেন, তার জানালা ছিল না। তাঁরা দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। তিনি জানান, ক্ষতিপূরণ আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সরকার।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল আহসান বলেন, 'আমি ঘটনাটি শুনেছি। তবে নিহতদের তালিকা এখনো পাইনি।'
গতকাল বিকেলে সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা জাহান নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে ভূশ্চি এলাকায় যান।
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, বাহরাইনে নিহতদের একজন সৈয়দ আহমেদের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। তিনি একজন ঠিকাদার ছিলেন। নিহত অন্যদের সঙ্গে তিনিও বাহরাইনে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। শনিবার রাতে রান্নাঘর থেকে গ্যাস সিলিন্ডারের গ্যাস বেরিয়ে পুরো ঘর ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে সময় তাঁরা ঘুমিয়ে ছিলেন।
নিহত সৈয়দ আহমেদের ছোট ভাই সদ্য বাহরাইন ফেরত হাফেজ আহমেদ জানান, সাত বছর আগে তিনিই বড় ভাই সৈয়দ আহমেদকে বাহরাইনে নিয়ে যান। তার পর থেকে তিনি আর দেশে ফেরেননি। গতকাল দুপুরে তাঁরা ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারেন। ফরিদগঞ্জের লোহাগড় গ্রামে তাঁদের বাড়ি। বাবা মৃত আবদুল জলিল মুন্সি। মায়ের নাম হালিমা বেগম। সৈয়দ আহমেদের দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে জান্নাত বেগম ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। দুই ছেলে নাদিম ও নাঈম দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। স্ত্রী লাভলী বেগম স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে এখন বাকরুদ্ধ। বৃদ্ধা মা হালিমা বেগম সন্তানের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে কথা বলতে পারছেন না।

No comments

Powered by Blogger.