২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা-হাওয়া ভবনে তারেক-বাবরের সঙ্গে মুফতি হান্নানের বৈঠক!-আদালতে সিআইডি কর্মকর্তা আবু হেনা

আওয়ামী লীগের ২১ আগস্টের সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত ছিলেন জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও তাঁর দল হরকাতুল জিহাদ (হুজি)। ওই হামলার জন্য সহায়তা চেয়ে হাওয়া ভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে তাঁরা বৈঠক করেন।


নিরাপত্তার ব্যবস্থা করায় সমাবেশে হামলা চালিয়ে তাঁরা নিরাপদে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলায় মুফতি হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার এ তথ্য। তবে সময়কাল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট আমল হওয়ায় তা প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তা আবু হেনা মো. ইউসুফকে। রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। গতকাল রবিবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এ ২১ আগস্টের বোমা হামলা মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসে তিনি জবানবন্দিতে এ কথা বলেন।
আবু হেনা আরো জানান, তৎকালীন অতিরিক্ত আইজি খোদা বঙ্ চৌধুরী, এএসপি মুন্সী আতিক ও বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিনের বাধার কারণে তিনি আদালতে মুফতি হান্নানের ওই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করতে পারেননি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলায় সিআইডি কর্মকর্তা আবু হেনার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৩ ও ৪ জুন ধার্য করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দীন এ দিন ধার্য করেন। নাজিমউদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিশেষ এজলাসে এ মামলার শুনানি হয়।
গতকাল আদালতে আবু হেনার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দি শেষে সাক্ষীকে জেরার জন্য আদালতে সময় আবেদন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। আদালত ওই আবেদন মঞ্জুর ও পরবর্তী দিন ধার্য করেন।
এদিকে এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর আসেননি। সংসদে বাজেট অধিবেশন থাকায় তিনি আসতে পারেননি বলে আদালতকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি সৈয়দ রেজাউর রহমান। গত ২০ মে আদালতে এসে মামলায় সাক্ষ্য দিতে মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও সিআইডি পরিদর্শক আবু হেনাকে সমন দেওয়া হয়।
গতকাল আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে জবানবন্দিতে আবু হেনা বলেন, বর্তমানে তিনি টাঙ্গাইল জেলায় সিআইডি পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০০৩ থেকে ২০০৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর রমনা-কোতোয়ালি জোনে সিআইডি পরিদর্শক পদে কর্মরত ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে ২০০৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন এবং তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার তদন্তকালে ২০০৬ সালের ১৩ আগস্ট মুফতি হান্নানকে ওই মামলায় রিমান্ডে নিয়ে তিনি টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
জবানবন্দিতে আবু হেনা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে মুফতি হান্নান রমনা বটমূলে বোমা হামলা ছাড়াও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তিনি ও তাঁর দল জড়িত ছিল বলে স্বীকার করেন। ওই হামলার সহায়তার জন্য হাওয়া ভবনে তারেক রহমান এবং বাবরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাঁরা তাঁকে সহায়তা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। এ কারণেই ওই সমাবেশে হামলা চালিয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছিলেন বলে হান্নান স্বীকার করেন।
আবু হেনা মো. ইউসুফ জবানবন্দিতে আরো বলেন, মুফতি হান্নানের রেকর্ড করা ওই সব জবানবন্দি তৎকালীন অতিরিক্ত আইজি খোদা বঙ্ চৌধুরী, এএসপি মুন্সী আতিক ও বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিনকে দেখান। এ বিষয়ে আদালতে হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করার ব্যাপারে তাঁদের মতামত চান। তাঁরা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়ে মুফতি হান্নানের বক্তব্য থাকায় তাঁর (ইউসুফ) ওপর বিরক্ত হন। তাঁরা বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাঁরা। তাই এ ব্যাপারে ইউসুফকে নাক গলাতে নিষেধ করেন এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়টি বাদ দিয়ে রমনা বটমূলসহ অন্যান্য বিষয়ে মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। এ কারণে মুফতি হান্নান ওই সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তিনি ও তাঁর দল জড়িত থাকার কথা জানালেও এ বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করতে পারেননি আবু হেনা।
গত বছরের ৩ জুলাই সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরো ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
গত ১৮ মার্চ সম্পূরক অভিযোগপত্রভুক্ত ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ প্রথম অভিযোগপত্রভুক্ত ২২ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
মামলাটিতে প্রথম অভিযোগপত্র হওয়ার পর বাদীসহ ৬৫ জনের সাক্ষ্য শেষ করেছিলেন আদালত। সম্পূরক অভিযোগপত্র হওয়ার পর আগের ৬৫ জনের সাক্ষ্যের মধ্যে শুধু বাদীকে (শরীফ ফারুক আহেমদ) সম্পূরক অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের পক্ষে জেরার জন্য আদালতে ডেকেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল এ মামলায় কারাগারে থাকা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ অন্য আসামিদের আদালতে নিয়ে আসা হয়।
এ মামলায় জামিনে থাকা পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শক মো. আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বঙ্ চৌধুরী এবং মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, এএসপি আবদুর রশীদসহ বিএনপির ঢাকা মহানগর শাখার নেতা ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফও আদালতে হাজির ছিলেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা, রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। আহত হন শতাধিত নেতা-কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.