হাসিনা-খালেদার রাজনীতি আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে by মাহবুবুর রহমান

‘হাসিনা-খালেদা রাজনীতি করে আমার স্বামীরে মেরে ফেলেছে। আল্লাহ তুমি এর বিচার করো।’ মাটির দেয়াল ঘেরা কুঁড়েঘরের মেঝেতে স্বামী হারানোর বেদনায় গড়াগড়ি দিয়ে এভাবেই বিলাপ করছিলেন তিন সন্তানের জননী হাওয়া বেগম। স্বজন আর প্রতিবেশীদের কোনো সান্ত¡নাই নিবারণ করতে পারছিল না তার কষ্ট।
জন্মাদাতাকে হারিয়ে মায়ের কষ্টের দোসর হয়ে অঝোরে কাঁদছিল হাওয়া বেগমের তিন সন্তানের দু’জন। এ সময় মেজ সন্তান ছিল তার স্বামীর বাড়িতে।
শনিবার বিকেলে ঢাকায় ঈগল পরিবহনের চালক বদর আলী বেগের মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর বাংলানিউজ খুলনা জেলা সংবাদদাতা তাৎক্ষণিকভাবে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এ হৃদয়বিদারক দৃশ দেখতে পান।

বদরের স্ত্রী আর সন্তানদের করুণ আহাজারিতে ভারি হয়েছিল চারপাশের বাতাস।

বদরের ছোট মেয়ে আইরিন (১৪) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার আব্বা কি অপরাধ করেছিল। আমরা কার কাছে যাব। কে আমার লেখাপড়ার ভার নেবে? আব্বার আশা ছিল আমাকে এসএসসি পাসকরাবে। কিন্তু আব্বা তা দেখে যেতে পারলো না।’

বদরের একমাত্র ছেলে অসুস্থ শামীম আলী বেগ (২৬) কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আব্বা গত শুক্রবার রাত ৯টায় ঈগল পরিবহনের গাড়ি নিয়ে ঢাকায় গেছে। আব্বা ঢাকা পৌঁছানোর পর ফোন দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। শনিবার বিকেলে আব্বার নাম্বারে ফোন দিলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে শুনতে পাই আমার আব্বার গাড়িতে আগুন দিয়ে তাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।’ কথাগুলো বলে হু হু করে কেঁদে ওঠে শামীম।

শামীম সরকারের কাছে দাবি জানান, তার মৃত বাবাকে নিয়ে যেন কোনো রাজনীতি না হয়। তিনি তার বাবার লাশ দ্রুত বাড়িতে চান।

বদর আলী বেগের জন্ম ১৯৬৭ সালে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার ২ নম্বর দামদর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দামদর পূর্বপাড়া গাঙকুল গ্রামে। পিতা মৃত হাসান আলী বেগ। বদর আলীরা তিন ভাই ও এক বোন। অপর দু’ভাইয়ের নাম ফরহাদ আলী বেগ ও জবেদ আলী বেগ। আর একমাত্র বোনের নাম ইসমত আরা।

বাবার মৃত্যুর পর বদর আলী ১৯৯২ সালে খুলনা নগর পরিবহনে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে সংসারের হাল ধরে ছোট তিন ভাইবোনকে বড় করেন। বছর তিনেক পর তিনি নগর পরিবহনের চালক হন এবং দীর্ঘকাল নগর পরিবহনের চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গত ৬ মাস যাবত তিনি ঈগল পরিবহনে চালক হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছিলেন।

বদরের স্ত্রী হাওয়া বেগম (৪০) দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন। বৈবাহিক জীবনে বদর তিন ছেলেমেয়ের বাবা। ছেলে শামীম আলী বেগ শরীরিক অসুস্থতার কারণে লেখা পড়া করতে পারেননি। মেয়ে আশা বেগমের (২০) বিয়ে হয়েছে বরিশালে। আর সবার ছোট আইরিন (১৪) দামদর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী।

প্রতিবেশীরা জানান, আধ কাঠা জমির ওপরে নির্মিত একটি মাটির ঘর ছাড়া বদর আলীর আর কোনো সহায়সম্পদ নেই।

ফুলতলা উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সামসুন্নাহার কুমকুম বাংলানিউজকে জানান, বদর আলী বেগ তার চাচাতো ভাই।

বদর স¤পর্কে তিনি বলেন, বদর সহজ-সরল মানুষ ছিল। বদরের পিতা ছোটবেলায় মারা যাওয়ায় বদর বড়ভাই হিসেবে সব ভাইবোনের ভরণ যুগিয়েছে। সে কোনো দিন কারো সঙ্গে কটু কথা কিংবা কোন ধরনের প্রতারণা করেনি। অন্যন্যা গাড়ি চালকদের ন্যায় তার কোনো বাড়তি আয় ছিল না। যার কারণে জীবনে কোনদিন স¤পদ করতে পারেনি সে।

পূর্বপাড়া গাঙকুল গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ মো. আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, বদর অতি দরিদ্র মানুষ ছিল। যা আয় করতো তা দিয়ে ছেলে ও অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা হতো না। গ্রামের মানুষ তাকে বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা করতো।

বদরের মেজভাই ফরহাদ আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভাই হারানোর বেদনা এত কঠিন আগে বুঝিনি। বাবার মৃত্যুর পর বড়ভাই আমাদের বড় করেছে। দেশের নোংরা রাজনীতি আজ সেই ভাইকে কেড়ে নিল।‘

তিনি সরকারের কাছে তার অভাবী ভাইয়ের সংসার চালানোর দায়ভার বহন করার অনুরোধ জানান।

প্রসঙ্গত, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী গত মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন।

ইলিয়াসের পরিবার ও বিএনপির অভিযোগ, হত্যা বা গুম করার উদ্দেশ্যে তাকে অহরণ করা হয়েছে।
এর প্রতিবাদে রোববার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি।

হরতালের আগের দিন শনিবার দুপুর ২টার দিকে থেকে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ঈগল পরিবহনের বাসে ধরিয়ে দেওয়অ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান বাসটির চালক বদর আলী বেগ।

No comments

Powered by Blogger.