দূরের দূরবীনে-গণতান্ত্রিক চোখে বাম বিপর্যয়, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে by অজয় দাশগুপ্ত

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রশ্ন করেছেন, দেশ-বিদেশের রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করা কী বন্ধ করে দিয়েছি, না উৎসাহ হারিয়েছি? তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর দিতে মন চায়নি। বাংলাদেশের খবরের কাগজ বা অন্যান্য মিডিয়াজুড়ে রাজনীতির খবর আর লেখালেখির তাণ্ডব, ইলেকট্রনিক মিডিয়াও তাই।


এত আলোচনা-সমালোচনার ঘনঘটা বাকস্ফূর্তিতে নতুন করে ইন্ধন জোগাতে মন চায় না। তা ছাড়া থাকিও অনেক দূরে, এমন এক দেশে যেখানে রাজনীতি তার উদগ্র চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে না। সরকার, দল, আমলাতন্ত্র, জনগণ_সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সবাই জানে তাঁরা কী করছেন, অনেকটা চীন দেশের সুড়ঙ্গ নির্মাণের গল্পের মতো। একদল শুরু করে একপ্রান্তে, অন্য দল সূচনা করে সুড়ঙ্গের বিপরীত দিক থেকে, মাঝখানে থাকে আরেক দল। একসময় সবাই এসে একবিন্দুতে মিলিত হয়। আর যখন তা ঘটে তখন সুড়ঙ্গ নির্মাণ শেষ। নিজেরাই বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করে আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে তাঁরা। আমাদের রাজনীতি বা অন্য প্রক্রিয়াগুলোর মূল সমস্যা তাঁরা জানেন না তাঁরা কী করছেন। আর জানলেও একবিন্দুতে মিলিত হওয়ার পক্ষে নয়। সে বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে প্রতিপক্ষ হওয়ার সাধনাকে উৎসাহী করার পক্ষে নই আমি। তবু মাঝেমধ্যে এমন কিছু বিষয় মাথাচাড়া দেয়, তা দৃষ্টি এড়িয়ে চলা অসম্ভব।
পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচন ও ফলাফল নিয়ে বিশ্ব বাঙালির কৌতূহল ছিল শীর্ষে। মানুষ সর্বদা পরিবর্তনের পক্ষে। একঘেয়ে, একপেশে ক্রমাগতভাবে অচলায়তন হয়ে ওঠা যেকোনো বিষয় বা প্রক্রিয়াকে ছুড়ে ফেলে নতুনকে আহ্বান ও আলিঙ্গনের জন্য উন্মুখ-উদগ্রীব। পৃথিবীও এসে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন এক বাস্তবতায়। একসময় দুনিয়াজোড়া বিপ্লব আর সাম্যবাদের ঢেউ উঠেছিল। ইউরোপের এক বিশাল অংশজুড়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো জাগিয়েছিল নতুন সম্ভাবনা। কাল মার্কস যে তত্ত্ব ও মতবাদ দিয়ে স্বপ্ন জাগিয়েছিলেন তার কর্ণধার হয়ে উঠেছিলেন লেনিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সে আশার প্রদীপ ইউরোপ পেরিয়ে পেঁৗছে গিয়েছিল লাতিন দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায়। আশার সলতে উসকে উঠে উপমহাদেশেও বিপ্লবের বহ্নিশিখায় জেগে উঠেছিল শোষিত মানুষ। সে এক আশ্চর্য! সময়কাল, লবঙ্গ বনে ঝড় বলে একটা কথা চালু আছে। যে যে অর্থেই ব্যবহার করুক না কেন, মূলত তা সাম্যবাদের প্রবল হাওয়ার পূর্বাভাস। ইন্দো-চীন থেকে ভারত, রাশিয়া থেকে আলবেনিয়া নতুন আশার বীজ এক জীবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো জাতিগুলোর ধারণা ছিল জমিহীন উপেনের স্বপ্ন মিলে যাবে লুবুম্বার প্রাণে। কম্বোডিয়ার চাষির ধানে জেগে উঠবে সুমাত্রার সোনালি বন্দর। পদ্মা ও গঙ্গার তীরে সে হাওয়ার দোলা লাগতে বিলম্ব ঘটেনি। অর্থনৈতিক ও শিক্ষা খাতে পিছিয়ে থাকার পরও উপমহাদেশের রাজনীতি বর্ণাঢ্য। তার প্রতি পরতে আছে গুণী ও রুচিবান মানুষের জাদুর হাত। অখণ্ড ভারত অথবা উপমহাদেশে সাম্যবাদ ও শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন তাই দ্রুত সঞ্চারিত হতে পেরেছিল। হওয়ারই কথা, আমাদের দেশে প্রচলিত ধর্মগুলোর ভেতর বৌদ্ধ ধর্ম স্বভূমি থেকে উৎসারিত। ধর্মকর্তা বা প্রধান মানুষটির জন্ম ও কর্মক্ষেত্রও আমাদের ভূমি। তাঁর জীবন ও দর্শন শ্রেণীহীন, সাম্যবাদের উজ্জ্বল এক উপমা। সিদ্ধার্থ রাজা রাজপুত্র, সিংহাসন, সুন্দরী স্ত্রী, পুত্র ও সমাজের মোহ ত্যাগ করে এক কাপড়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। শুধু কি তাই? তাঁর মতো করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে অকপট সত্যও বলেননি কেউ। ধর্ম প্রচারক, সম্ভগুরু বলেছেন, ঈশ্বর আছে কি নেই সে বিষয়ে জানার প্রয়োজন ক্ষীণ। তর্কের কারণ নেই। তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বস্তুবাদ, যা দেখছি তাতে বিশ্বাস করাই ধর্ম! আরো এক ধাপ এগিয়ে বুদ্ধ কর্মফলকেই নিয়তি বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। নিজ ধর্মাবলম্বীদের অদৃশ্য, অলৌকিকত্বের কাছে সমর্পণের পরিবর্তে কর্মফলে অধিকার দিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণার বীজ বপনও তিনি তখনই করে গিয়েছিলেন। মার্কসবাদ বা লেনিনবাদ তাই এই উপমহাদেশে অদ্ভুত কোনো আমদানীকৃত ধারণা মনে হয়নি।
পদ্মা ও গঙ্গাপারের শিল্প-সাহিত্য, মনীষা বা সৃষ্টিতে আজও সে প্রমাণ জ্বলজ্বলে। আমাদের দেশের মন ও মননে বাম আদর্শ রামপন্থা, চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার স্থান অনেক গভীরে। মানবেন্দ্রনাথ রায়, কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ, এস এ ডাঙ্গে নাম্বুদ্রিপাদ, আমাদের বাংলায় মণি সিংহ, ভাসানী, তোয়াহা বা ফরহাদের মতো দর্শন ও রাজনীতির মানুষ আর কোনো দিন না-ও জন্মাতে পারে। আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধুর পর সর্বতোভাবে সার্থক ও ত্যাগী মানুষ তাজউদ্দীন, তাঁর চিন্তা-চেতনাও ছিল বাম ঘেঁষা। সাহিত্যে পরিচয় গোষ্ঠী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সেন, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সে এক অনন্ত ফল্গুধারা। সংগীতে গণনাট্য সংঘ, নাটকে পিপলস লিট্ল্ থিয়েটার, উৎপল দত্ত, অজিতেশ, মৃণাল সেন, ঋতি্বক ঘটক, সলিল চৌধুরী। সব মিলিয়ে তোমার আমার ঠিকানা_পদ্মা মেঘনা যমুনা অথবা গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মার বর্ণিল আহ্বান, বামপন্থা, পূর্ববঙ্গ অধুনা বাংলাদেশে আদর্শের খুঁটি গেড়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে পেঁৗছে গেলেও ক্ষমতার মুখ দেখেনি, হতে পারে সাম্প্রদায়িকতা, হতে পারে পাকিস্তানি শাসনের ডাণ্ডাতন্ত্র অথবা মন ও মনের বিপরীতধর্মী অদ্ভুত চরিত্র। বাংলাদেশের বাম আন্দোলন ছাত্র ও যুবশক্তির সীমানা ডিঙিয়ে মধ্যবিত্তের ভেতর কখনোই তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি, সবাই জানেন এঁরা ভালো মানুষ, আদর্শনিষ্ঠ, কর্তব্য ও দেশপ্রেমে খাঁটি; কিন্তু ওই এক কথা, অত নরম ও ভদ্র রাজনীতি দিয়ে বাংলাদেশ শাসন করা অসম্ভব। অন্যদিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ছায়াসঙ্গী, বলিষ্ঠ সমর্থক ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সঠিক ভূমিকার জন্য কংগ্রেসকে শেষবার পুরস্কৃত করেছিল ১৯৭২ সালে। বিলেতে রাষ্ট্রদূত সৌম্যদর্শন, সফেদ ধূতি-পাঞ্জাবির সিদ্ধার্থ শংকর রায়ই ছিলেন ওই বাংলার সর্বশেষ কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী। সিদ্ধার্থ রায়ের বিদায়ের পর আর কেউ সিদ্ধি লাভ করতে পারেননি। ৩৪ বছর ধরে একটানা বাম শাসনের ভেতর দিয়ে গেছে ওই বঙ্গ।
বাম শাসন বা বাম চরিত্র খসে পড়েছিল মেয়েদের শরীরের ভূষণের মতো। মার্কসবাদ, লেনিনবাদ থেকে শুধু মার্কসবাদ। অতঃপর পলিটব্যুরো শাসনের পরিবর্তে একধরনের দলীয় গণতন্ত্র, বহুদলীয় নির্বাচন, কখনো উগ্র চীনপন্থী, কখনোবা জ্যোতি বসুর একগুঁয়েমি_সব মিলিয়ে ধুন্দুমার আবার একেবারে সাদামাটা ম্যাড়ম্যাড়ে শাসনামল। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই বাংলার তারুণ্য বা জেদি চরিত্রের ৩৪ বছর একটানা একপেশে শাসনে পোষমানা গৃহপালিত প্রাণীর অবস্থা তার। মানতে মানতে হিন্দির আগ্রাসন, মাড়োয়ারির জুলুম, অন্য রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের বাজার দখল, সিনেমা থিয়েটারের লগি্ন_সবই মেনে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। তার পরও সে তো ভারতের অঙ্গ, ভারতের শরীরে লাগা নবদুনিয়া ও বিশ্বায়নের হাওয়া এড়িয়ে থাকা কি সম্ভব? থাকেনি, থাকতে পারেনি। পারেনি বলেই অচলায়তন ভেঙে ক্ষমতায় এসেছে নতুন কংগ্রেস, মা, মাটি ও মানুষের স্লোগানে ভর করা দলের অভূতপূর্ব বিজয়।
পশ্চিমবঙ্গ এগোবে না থমকে দাঁড়াবে, না পেছনে যাবে সে ভাবনা তাদের। শুধু একটি উদাহরণ দিয়েই শেষ করব। স্বাধীনতার পর এমনকি আশির শুরুতেও কলকাতার বিদ্যুৎ সমস্যা ছিল ভয়াবহ। সে এক জ্বলন্ত উৎপাত। দিনের ভেতর চৌদ্দবার বাতি নিভে যাওয়া ক্ষয়িষ্ণু বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ছিল অভিশাপের মতো। আমরা তখন তাড়িয়ে তাড়িয়ে অপচয় আর ভবিষ্যৎ ভাবনাহীন ইলেকট্রিক আনন্দে মশগুল। আজ চিত্রটি ঠিক তার বিপরীত। জাদুমন্ত্রে উধাও বৈদ্যুতিক সমস্যায় কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ স্বনির্ভর। আর আমাদের বিদ্যুৎ তথা ব্যবসাজুড়ে শনির ভর। দুই বাংলার মধ্যে জেদ ও অহংকারে আমরা এগিয়ে থাকলেও রাজনীতির তফাত রেখেছে পিছিয়ে। ওই বঙ্গে ৩৪ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতায় থাকা দল হেরে গিয়ে বলছে, মেনেছি এবং উন্নয়নের পথে তোমাদের সঙ্গে আছি, বিজয়ী বলছে বদলা নয়, বদল চেয়েছি। যেদিন আমাদের রাজনীতি এ ভাষা শিখবে, এ-জাতীয় আচরণ করতে জানবে, সেদিনের জন্যই তোলা থাক রাজনৈতিক লেখালেখি। সিডনির শীতার্ত দিনগুলো কখনোই রাজনৈতিক উত্তাপে উষ্ণ হয় না, এ-ও এক সমস্যা। যেটুকু উত্তাপ তার পুরোটাই অন্য কোনো জরুরি অনুষদের।
লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.