নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-মেয়েটির নিরাপত্তা নেই, ছেলেটিও কি নিরাপদ? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী হিসেবে এ দেশের মেয়েদের পাঠানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। পাঠানো হলেও অন্তত তাঁদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি যাতে নিশ্চিত করা হয়, সেই দাবি তাঁরা জানিয়েছেন সরকারের কাছে। রিয়াদ থেকে একজন প্রবাসী বাঙালি ফরহাদ আহমেদ ফোন করে বলেছেন, ‘সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের ‘খাদ্দামা’


বলে। খাদ্দামাদের কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা এখানকার সবাই জানে। কাজেই আমরা আমাদের মা-বোনদের এভাবে নির্যাতিত হতে দিতে পারি না। বাংলাদেশ সরকারের কোনোভাবেই এখানে নারীদের পাঠানো ঠিক হবে না।’ (প্রথম আলো, ৭ মে)
এই উদ্বেগ আন্তরিক। পুরুষ শ্রমিকেরা বিদেশে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় প্রতারিত হন, প্রাপ্য পারিশ্রমিক ও সুবিধাদি পান না। তবু জীবিকা নির্বাহের জন্য, দেশে স্বজনদের কাছে কিছু অর্থ পাঠানোর জন্য এসব বঞ্চনা মুখ বুজে সহ্য করেন। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে দায় শোধ করতে হয় অন্যভাবেও। এখানেই প্রবাসী ফরহাদদের মনোবেদনা ‘আমাদের মা-বোন’ কথাটির মধ্যে স্বদেশি নারীদের প্রতি আত্মীয়তার বোধ, তাঁদের অবমাননায় নিজেদের অসহায়ত্ব ও বেদনার অভিব্যক্তিটি উঠে এসেছে। আমরা চাই, এ ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করুক সরকার।
কিন্তু ফরহাদের এই মা-বোনেরা কি নিজের দেশেও নিরাপদ? এখানে ‘খাদ্দামা’ বলা হচ্ছে না বটে, কিন্তু জীবিকা নির্বাহের জন্য তাঁদেরও কি সম্ভ্রম এমনকি জীবন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে না খোদ স্বদেশি মানুষের হাতেই? যেদিন সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেই একই দিন (৭ মে) প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরেকটি সংবাদ আরও হূদয়বিদারক। কক্সবাজারের পিতৃ-মাতৃহীন দুই কিশোরীকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে চট্টগ্রাম শহরে এনেছিল জাহাঙ্গীর নামের (২৬) নামের এক যুবক। বহদ্দারহাটে এক বাসায় আটকে রেখে ওই দুই মেয়েকে দুই দিন ধরে ধর্ষণ করেছে জাহাঙ্গীর ও তার বন্ধু রফিকুল ইসলাম। এই পাশবিকতার ধকল সইতে না পেরে রুমা আক্তার (১৩) ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে, অন্য কিশোরীটি কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছে। এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা?
শুধু যে জীবিকার সন্ধানে আসা গরিব ঘরের মেয়েরাই যৌন বিকৃতির শিকার হচ্ছে, তা-ও নয়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত চারটি বিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে উঠেছে ছাত্রীদের ওপর যৌন হয়রানির অভিযোগ। পর পর চারটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই রকম অভিযোগ ওঠায় অনেকে বিস্মিত। কেন প্রায় কাছাকাছি সময়ে এ রকম অভিযোগ উঠল, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন। কিন্তু সাংবাদিকদের তদন্ত থেকে যে কথা বেরিয়ে এসেছে তা হলো, এত দিন বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা গৃহশিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে মেয়েরা যেমন ভয়ে-লজ্জায় মুখ খুলত না, তেমনি এ ধরনের ঘটনা জানার পর মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অভিভাবকেরাও বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একজন কেউ সাহস করে প্রতিবাদ জানালে বাকিরাও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন, সোচ্চার হয়ে উঠেছেন প্রতিকার চেয়ে।
শৈলবালা বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী ও তার বাবার অভিযোগের সূত্রে একই বিদ্যালয়ের অন্তত আরও দুজন ছাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যারা অভিযুক্ত শিক্ষকের অনৈতিক আচরণের শিকার হয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া, এমনকি পড়ালেখাই ছেড়ে দিয়েছে। এদের একজন খোদ এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সামনে তার প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তার বর্ণনা দিয়েছে নিঃসংকোচে। হয়তো তার মতো অন্য একজন ভুক্তভোগীর রুখে দাঁড়ানোর সামর্থ্য দেখে সাহসী হয়ে উঠেছে মেয়েটি। অথচ আরও আগে এই সাহসটুকু দেখাতে পারলে হয়তো শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যেত না তার।
নগরের কৃষ্ণকুমারী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, শহীদনগর উচ্চবিদ্যালয় ও অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও এসব ঘটনা ঘটেছে।
অপর্ণাচরণের অভিযুক্ত শিক্ষক তাঁর ওপর আনা অভিযোগ অস্বীকার করে একে ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। এমনকি নিপীড়নের শিকার মেয়েটিকে মানসিক ভারসাম্যহীন প্রমাণেরও চেষ্টা করেছেন। কোনো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবা নিজের মেয়ের সঙ্গে গৃহশিক্ষকের কুৎসিত আচরণের কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করে শিক্ষককে ফাঁসাতে চাইবেন, ‘ষড়যন্ত্রের’ এ তত্ত্ব আমাদের সমাজে অন্তত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তা ছাড়া মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মেয়ে একটি বিদ্যালয়ে সব কটি ক্লাসে ভালো ফলাফল করার পর, অন্য একটি বিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে প্রমাণ করেছে, তার ওপর চাপানো অপবাদ কতটা অসার।
এভাবে চারটি বিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষকই কোনো না কোনোভাবে অভিযোগ অস্বীকার করে ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর চেষ্টা করেছেন। এসব ব্যাপারে তাঁদের সমর্থন দেওয়ার লোকজনও জুটে যাচ্ছে সহকর্মী কিংবা পরিচিতজনদের ভেতর। অথচ এ ‘সমর্থকেরা’ ভেবে দেখছেন না সমাজে এ বিকৃতমনস্কতার প্রসার ঘটলে তাঁদেরও বোন বা কন্যা তার শিকার হতে পারে।
আমাদের ধারণা, সমাজে মুখ বুজে অনিয়ম সহ্য করার পরিবর্তে প্রতিবাদপ্রবণতা বাড়ছে বলেই যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে বেশি। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমেই এর পুনরাবৃত্তি বন্ধ হতে পারে।
রুমা আক্তারের ধর্ষক ও হত্যাকারী জাহাঙ্গীর ও রফিকুল এখনো ধরা পড়েনি। তার পক্ষে থানা-আদালতে দেনদরবার করার কেউ নেই। জানি না কিশোরীটির এই নির্মম মৃত্যু আমাদের আইনের রক্ষকদের কর্তব্যবোধকে স্পর্শ করতে পারবে কি না! আর যারা বেঁচে আছে—একটি ভালো চাকরির জন্য শহরে আসা মেয়েটি, ভালো বিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া মেয়েটি, পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের আশায় গৃহশিক্ষকের দ্বারস্থ মেয়েটি—যদি তাদের ওপর ঘটে যাওয়া পাশবিক আচরণের প্রতিকার না পায়, তাহলে বাকি জীবন এই দুঃস্বপ্ন বহন করতে হবে তাদের। এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজ-সংসারকে মুক্তি দেবে না।
আমাদের দেশ ও সমাজে মেয়েরা কতটা অসহায় এবং সে কারণেই কন্যাসন্তান কতটা অনাদৃত, তা আমরা জানি। কিন্তু ছেলেরাও কি নিরাপদ? দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোরদের কথা ছেড়েই দিলাম। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, বিত্তবান পরিবারের অভিভাবকেরাও কি সন্তানদের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন?
নারীনীতির প্রতিবাদে মিছিলে হাটহাজারী বা অন্যান্য মাদ্রাসা থেকে যে শিশু-কিশোরেরা তলোয়ার হাতে বেরিয়েছিল, তারা কি জানে নারীনীতিটি আসলে কী? পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এদের মধ্যে যে কিশোরটি আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়ে গেছে সারা জীবনের জন্য, এমনকি মৃত্যু হয়েছে যে ছাত্রটির, তার মা-বাবার সান্ত্বনা কী? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে শুধু বসার জায়গা নিয়ে, সামান্য বসার ফলে যে ছাত্রটি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেল, পঙ্গু হাসপাতালে শুয়ে থাকা যে ছাত্রটির শরীরে অন্তত দেড় শটি সেলাই দিতে হয়েছে, তাঁর মা-বাবা কার কাছে যাবেন নালিশ করতে?
এ রকম অজস্র ঘটনা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা ওল্টালেই চোখে পড়ে। কিছুদিন আগে (২৮ এপ্রিল, প্রথম আলো) শরীরের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে র্যাগিংয়ের নামে জুনিয়র ছাত্রদের ওপর উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের নির্যাতনের বিবরণ পড়ে। উপড়ে ফেলা হয়েছে পায়ের নখ। হ্যাঙার দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে সারা শরীর, নির্যাতনের ভয়াবহতায় প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বেরোচ্ছে কারোর, কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে এক ছাত্রের! কোনো পূর্বশত্রুতা নেই, স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই, এমনকি রাজনৈতিক বিরোধের সচরাচর ঘটনাও নয়, শুধু আমোদ-ফুর্তি করতে গিয়ে নবাগত কিছু ছাত্রের ওপর তাদের বড় ভাইয়েরা এ রকম ভয়াবহ অত্যাচার করতে পারে—এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা দোষীদের শাস্তি দেবে—এসব সান্ত্বনার বাণী ক্ষতিগ্রস্তদের আরও ক্ষুব্ধ এবং সাধারণ নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করে তুলবে সন্দেহ নেই। কারণ, তাদের নাকের ডগায় এসব ঘটনা ঘটছে বছরের পর বছর। কর্তৃপক্ষের এসব উদ্যোগের প্রতি অভিভাবকদের যে আস্থা নেই, তার প্রমাণ—অন্তত ছয়জন ছাত্রের অভিভাবক তাঁদের সন্তানকে আর একাডেমিতে ফেরত না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুধু মেরিন একাডেমিতে নয়, র্যাগিংয়ের এ নির্মমতা চলছে আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন। কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? মেরিন একাডেমির মতো ট্র্যাজেডি ঘটার আগেই র্যাগিং নামের নির্মমতা বন্ধের উদ্যোগ কি নেবেন অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা?
আমাদের মেয়েরা কবে যৌন বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা পাবে? আমাদের ছেলেদের শৈশব-কৈশোর নিরাপদ হবে কবে?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.