চরাচর-নগরজীবনে বিড়ম্বনার দীর্ঘ ছায়া by বনরূপা

শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, নদীদূষণ ইত্যাদি কারণে এই নগরবাসীর জীবনে শুধু বিড়ম্বনার ছায়াই দীর্ঘ হচ্ছে না, এসবের কারণে মানুষের নিঃশব্দ ক্ষতি হচ্ছে বিপুল, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। অব্যাহত দূষণের কবলে মানুষের হাঁটাচলা কিংবা বেড়ানোর জন্য ক্রমেই অনুপযোগী হচ্ছে আমাদের এই প্রিয় শহর ঢাকা, যাকে তিলোত্তমা হিসেবে গড়ে তোলার


উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ইতিমধ্যে আমরা শুনেছি বিস্তর। ফুটপাত ধরে হাঁটবেন এর উপায় নেই। বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মল হাওয়ার আশায় ছুটবেন তো গিয়েই হোঁচট খাবেন। বুড়িগঙ্গা ক্রমেই মরছে কিছু মানুষেরই অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে। আর এর পানি ও তীরের চিত্র মানুষের স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্কে যাবেন? তারও উপায় নেই। নিকট-অতীতে একটি দৈনিকে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ, দীর্ঘদিন ধরে দখলবাজির কারণে ৩২টি পার্ক ইতিমধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নানা অপকৌশলে দখলের ফলে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে আরো ১২টি পার্ক। তা ছাড়া এখনো যেগুলো টিকে আছে বলতে গেলে কোনো রকমে, সেসব পার্কে যত্রতত্র আবর্জনা, মলমূত্র, ভাসমান যৌনকর্মী, মাদকাসক্ত আর সমাজবিরোধীদের জটলা, শান্তিপ্রিয় মানুষের সামনে বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। অনেক পার্কের মধ্যে কিংবা কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট স্থাপনা কিংবা নগর সার্ভিস বাসের কাউন্টার! আবার কোথাও কোথাও চোখে পড়বে পার্কের মধ্যে কিংবা কিনারে বিভিন্ন ক্লাবঘরের আস্তানা। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৫ মার্চ রাজধানীর ছোটবড় ৫৮টি পার্ক এবং ১০টি খেলার মাঠ ও পার্ক পরিচালনায় নির্মিত স্থাপনা ছাড়া অনুমোদনহীন সব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, গত এক বছরেও ডিসিসি, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর পার্ক ও মাঠ রক্ষায় উদ্যোগ নেয়নি, অপসারণ করেনি কোনো অবৈধ স্থাপনা। দখলপ্রক্রিয়াই যেন এ দেশে বড় প্রক্রিয়া, যেভাবে পারে সর্বত্র চালাতে চায় দখলের মহড়া। পার্ক, খেলার মাঠ, নদী দখলের অপক্রিয়া এখানে এত বেগবান যে এর চরম বিরূপ প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। সব মিলিয়ে মানুষের অর্থাৎ রাজধানীবাসীর জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। সবুজের ধ্বংসলীলাও চোখে পড়বে অহরহ। অথচ এসব দেখভালের দায়দায়িত্ব ও প্রতিকারের কর্তব্য যাদের, তারা নির্বিকার! তা না হলে কী করে এক বছর ধরে আদালতের নির্দেশ উপেক্ষিত আছে? পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতা-উত্তরও যে পরিমাণ সবুজ চত্বর, পার্ক, উন্মুক্ত স্থান এই মহানগরীতে ছিল, এখন তার অবশিষ্ট আছে কতটুকু, তা জানতে ব্যাপক গবেষণার দরকার নেই। ঢাকা মহানগরী যেসব কারণে ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে, এর মধ্যে দখলপ্রক্রিয়ার অপচ্ছায়া অন্যতম। পার্ক, মাঠ, বুড়িগঙ্গা কিংবা উন্মুক্ত স্থানগুলো দখলমুক্ত করতে মাঝেমধ্যে সামাজিক সংগঠনগুলোর তরফে কিছু কর্মসূচি পালিত হয় বটে, কিন্তু এ সব কিছুর ফলই যেন শূন্য। প্রশাসন ও বিভিন্ন বিভাগ বা দপ্তরের উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মানুষের জীবনে কতটা বিরূপ প্রভাব পড়ছে_এ প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধানেও গবেষণা করতে হবে না। ঘর থেকে দুই পা ফেলে এগোতে থাকলেই চোখে পড়বে বিড়ম্বনা ও অসহনীয় জীবনযাপনের নানা চিত্র। প্রশ্ন হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বাগাড়ম্বর ছেড়ে কাজের কাজগুলো সম্পন্ন করতে কি শুধুই অক্ষমতা প্রদর্শন করে চলবেন আর খেসারত দিতে হবে শান্তিপ্রিয়দের? জবাবদিহি-দায়বদ্ধতার পাট যাঁরা চুকিয়ে ফেলেছেন, তাঁরা কি প্রশ্নের ঊধর্ে্বই থাকবেন?
বনরূপা

No comments

Powered by Blogger.