সাভার-মানিকগঞ্জে উৎপাদন ব্যাহত by তায়েফুর রহমান

ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে সাভার ও মানিকগঞ্জের শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন। প্রয়োজনের চার ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রতিটি মিল-কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে আশঙ্কাজনক। বেশ কিছু ক্ষুদ্রশিল্প কারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।


মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম (কমার্স) অসিত কুমার সাহা জানান, এই জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ৫৫ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ২৬ মেগাওয়াট। তাঁর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, মানিকগঞ্জে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাপের শিল্প-কারখানা আছে প্রায় ৩৩০টি। এ ছাড়া বসুন্ধরা স্টিল, আকিজ পার্টিকেল অ্যান্ড হার্ডবোর্ড, মুন্নু ফেব্রিকস তারাসিমা অ্যাপারেলের মতো বড় মাপের শিল্প-কারখানা রয়েছে বেশ কয়েকটি। এসব কারখানায় প্রতিদিন বিদ্যুতের যে বিরাট চাহিদা, এর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বীকার করেন তিনি।
মানিকগঞ্জের জাগিরে অবস্থিত বসুন্ধরা স্টিল মিলস কমপ্লেক্সের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মো. এনামুল হক জানান, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে তাঁদের উৎপাদন কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আরো জানান, বসুন্ধরা স্টিল মিলের বিদ্যুৎ চাহিদা ১৭ মেগাওয়াট। কিন্তু তাঁরা পাচ্ছেন চাহিদার চার ভাগের একভাগ। কখনো আরো কম। বিশেষ করে বোরো মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। এনামুল হক বলেন, কখন বিদ্যুৎ যায়, তার কোনো হিসাব নেই। দেখা যায়, স্টিল মোল্ডিংয়ের (গলানো) সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। এই মোল্ডিং স্টিল ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আবারও মোল্ডিং করতে হয়। এতে খরচ ডাবল হয়ে যায়। তিনি জানান, বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাস সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে বসুন্ধরা স্টিলের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তারাসিমা অ্যাপারেল লিমিটেডের মেইনটেন্যান্স ম্যানেজার আজগর আলী জানান, তাঁদের চাহিদা প্রায় দুই মেগাওয়াট। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে অর্ধেকেরও কম। তিনি বলেন, তারাসিমা অ্যাপারেল সম্পূর্ণভাবে বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে। ফলে সময়মতো পোশাক তৈরি করতে বাধ্য হয়ে জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে প্রায় চারগুণ বেশি খরচ পড়ছে।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটিতে কড়াই তৈরি হয় শরিফ ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায়। বিদ্যুতের অভাবে কারখানাটি প্রায় বন্ধের মুখে। কারখানার মালিকদের একজন ফজলুর রহমান জানান, এখানে ২০০ শ্রমিক কাজ করেন। কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেলে এই ২০০ শ্রমিক কাজ করতে পারেন। কিন্তু গত এক মাস ধরে দু-তিন ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ না পাওয়ায় কারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছের ওই শ্রমিকরা। একই রকম অবস্থা সাটুরিয়ার আরো ছয়টি কড়াই কারখানার।
মানিকগঞ্জের বেওথা ঘাটে চালকলের মালিক শের খান জানান, দিনে সর্বসাকুল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় তিন-চার ঘণ্টা। ফলে তাঁর মিলটি প্রায় বন্ধের মুখে। মিল করতে গিয়ে দেনা আছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। অথচ মিল থেকে তাঁর রোজগার এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়।
সাভার : ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্ধেকের বেশি সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। এতে এই অঞ্চলের শিল্প-কারখানায় উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে রপ্তানিমুখী অনেক প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আশুলিয়ার বেসরকারি পাওয়ার স্টেশনে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি সাভার ও আশুলিয়ায় অবস্থিত শিল্প-কলকারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ কম হওয়ায় বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে কমে গেছে। তৈরি পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় সুতা এবং নিট শিল্পে কাপড় ওই এলাকার কারখানাগুলোতে উৎপাদিত হয়। এসব উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের প্রয়োজন হয়। সম্প্রতি সাভারে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা অভিযোগ করেন।
আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় অবস্থিত হরাইজন ফ্যাশন লিমিটেডের কারখানা ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান প্রিন্স কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের কারখানা এলাকায় লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করেছে। আগে লোডশেডিংয়ের সময় তিনি ২৩৫ লিটারের তিন ড্রাম ডিজেল দিয়ে প্রায় এক মাস কারখানা চালাতে পারতেন। কিন্তু গত মার্চ মাসে তাঁর ২৩৫ লিটারের ৯টি ডিজেলের ড্রাম লেগেছে। ফলে কারখানার উৎপাদন ঠিক রাখতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। তাঁদের উৎপাদনও কম হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই পোশাক শিল্পটির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সময়মতো মালামাল সরবরাহ করতে পারছেন না তাঁরা। শ্রমিকদের ওভারটাইম দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে।
সাভার পৌর এলাকার ইমান্দিপুর মহল্লায় অবস্থিত মনো গ্রুপের শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান, মনো প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, দিনে-রাতে সব সময়ই নিরবচ্ছিন্ন এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেলে তাঁকে পরের দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। লোডশেডিংয়ের সময় তিনি ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করেন। ডিজেল খরচ বাবদ তাঁর গত জানুয়ারি মাসে খরচ হয় প্রায় ৬১ হাজার টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসের খরচ ৮৫ হাজার ৪০০ টাকা এবং মার্চ মাসে খরচ হয়েছে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৬৫০ টাকা। তিনি বলেন, চার গুণেরও বেশি খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। দুই শিফট কাজ করেও তিনি সময়মতো মালামাল সরবরাহ করতে পারছেন না। এ ছাড়া ভোগান্তির শেষ নেই। ফিলিং স্টেশনগুলোয় গেলে সেখান থেকে চাহিদামতো ডিজেল সরবরাহ করা হয় না বলে তিনি অভিযোগ করেন। চার ড্রাম ডিজেলের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা হয় মাত্র এক ড্রাম।
এদিকে গ্যাস সংকটে পড়ে ঢাকা-আরিচা ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই পাশের অর্ধশতাধিক সিএনজি স্টেশন দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাসের চাপজনিত সমস্যায় ভোগে। ফলে সিএনজি রূপান্তরিত যানবাহনগুলো ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না।
আশুলিয়ায় দেওয়ান সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মালিক সাভারের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কের পাশের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
সাভারের পাকিজা ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার ফারুক খান চিশতী কালের কণ্ঠকে জানান, বিদ্যুৎ স্বল্পতার কারণে তাঁদের সব সময় গ্যাসচালিত জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই লাগলেও পাওয়া যায় মাত্র ১০ পিএসআই। তাই উৎপাদনে মাঝে-মধ্যেই ব্যাঘাত ঘটছে।
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত নির্জন অফসেট প্রেসের মালিক সাহেদ জুয়েল বলেন, বিদ্যুৎ সংকটে তাঁদের কাজ কমে গেছে। আগে তিনি যে কাজ একদিনে করতে পারতেন, এখন ওই কাজ করছেন তিন দিনে। ফলে শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে গেছে। অথচ দিনের বেশির ভাগ সময় শ্রমিকদের কাজ থাকে না। বসিয়ে বসিয়ে তিনি শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছেন।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোশারফ হোসেন দেওয়ান বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে হাসপাতালের রোগীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে দুই ঘণ্টা থাকে না। অনেক সময় অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে সমস্যায় পড়েন ডাক্তার। হাসপাতালে জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকলেও জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় মূলত বিদ্যুতের ওপরই নির্ভর করতে হয়।
ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১-এর সাভার জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) ইমরুল হাসান ভুঁইয়া জানান, বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে। সাভারে প্রায় ১০০ থেকে ১৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৬০ মেগাওয়াটেরও কম। তিনি আরো জানান, গ্যাস সংকটের কারণে আশুলিয়া পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বোরো ধানের জমিতে সেচের কাজ চলার কারণে আপাতত কিছুদিন লোডশেডিং বেশি দিতে হচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ লোডশেডিং চলবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

No comments

Powered by Blogger.