আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় by হারুন-অর-রশিদ

স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বজনবিধিত। ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থিত 'অপরাজেয় বাংলা' এরই স্বাক্ষর বহন করছে।


উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান সৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় উন্নয়নে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান সর্বজনবিদিত। শুধু জাতীয় উন্নয়ন বলি কেন, বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডারেও রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এসএন বোস বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে 'কোয়ান্টাম স্টাটিস্টিকস তত্ত্ব' রচনা করেন (১৯২৪), যা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বহু অজানা বিষয় জানা ও ব্যাখ্যার সুযোগ এনে দিয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আমাদের দেশের বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান ও অধ্যাপক ড. জেবা ইসলাম সিরাজ_ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল তরুণ শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় (যাদের মধ্যে প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগ এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা অন্তর্ভুক্ত) পাটের জন্মতত্ত্ব (জিনম সিকোয়েন্সিং) আবিষ্কার করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। এ আবিষ্কার 'সোনালি আঁশ' পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে এনে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বর্তমান উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার অধিক হার, উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জ্বালানির নতুন উৎস সন্ধান, শিল্পায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, এপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ, ভূতত্ত্ব, ফার্মেসি অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিচার্স ইন সায়েন্সেস, পপুলেশন সায়েন্সেস, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, নাট্যকলা, সঙ্গীত, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদ, দুর্যোগ গবেষণা প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। জ্ঞানচর্চার চিরায়ত ধারার পাশাপাশি মানবিকতা/ নৈতিকতাবোধের বিকাশ ও জাতীয় উন্নয়নই হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও আদর্শ। গবেষণার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। গুণ ও মানসম্পন্ন এবং সৃষ্টিশীল উচ্চশিক্ষাই পারে একটি জাতির মোড় ঘোরাতে। শিক্ষা-গবেষণা হতে হবে বিশ্বমানের। সৃষ্টি করতে হবে বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট। এ জন্য থাকা চাই আধুনিক ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ইন্টারনেটের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিকে সম্পূর্ণ অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনতে হবে। ই-বুক, ই-জার্নালের প্রাপ্ততা পর্যাপ্ত করতে হবে। শ্রেণীকক্ষগুলোকে ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দ্বারা সজ্জিত করতে হবে। বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হবেন রাষ্ট্র ক্ষমতা বা বিত্তবান হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত, শুধুই জ্ঞান আর গবেষণাকর্মে নিবেদিতপ্রাণ।
এ কথা নিদ্বর্িধায় বলা যায়, দেশের প্রধান বিদ্যাপীঠ হিসেবে এখন পর্যন্ত একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই উচ্চশিক্ষাকে ঘিরে জাতির উন্নয়নের ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও বহুসংখ্যক প্রশিক্ষিত শিক্ষক-গবেষক রয়েছেন এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই উন্নয়নের এ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবি রাখে। জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির স্বার্থেই সরকারকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ
উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.