আসন্ন বাজেট-বৈষম্য কমাতে হবে by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে দুই অর্থনীতিবিদের লেখা এখানে প্রকাশ করা হলো। তাঁরা অর্থনীতির চরিত্র বিশ্লেষণের পাশাপাশি প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে কিছু সুপারিশও করেছেন।


গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতগুলো ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। সরকারি হিসাবে দারিদ্র্য ২০০৫ সালে যেখানে ৪০ শতাংশ ছিল, সেখানে ২০১০ সালে এসে তা ৩১ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ ধরে রেখেছে। এ বছর প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বছর প্রকৃত কৃষি মজুরি বেড়েছে। এটা কর্মসংস্থান বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। সম্প্রতি রপ্তানি বেড়েছে। গত ছয় মাসে তা বৃদ্ধির পরিমাণ ৪১-৪২ শতাংশ। এর পাশাপাশি মূলধনি আমদানি বেড়েছে। চলতি বছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি আদায় করা গেছে। এগুলো ভালো দিক।
এবারের বাজেটে কতগুলো বিষয়ে নজর দিতে হবে। গত কয়েক বছরে আয় যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে বৈষম্য। কিছু মানুষের কাছে অর্থ গেছে, কিন্তু সবার কাছে ন্যায্যভাবে যায়নি। অথচ সামাজিক বৈষম্য কমানো ছিল সরকারের অঙ্গীকার। এ ক্ষেত্রে সরকার নিজের অঙ্গীকার পূরণে আরও উদ্যোগী হবে বলে আশা করি।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের মতো। আমি মনে করি, এটা ৫ শতাংশ হলে তা গ্রহণযোগ্য, তার বেশি নয়। তাই এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কতকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলো মূলত সংকোচনমূলক ব্যবস্থা। সংকোচনমূলক ব্যবস্থা অর্থনীতির গতি হ্রাস করতে পারে। সরকারকে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস না পায়, আবার মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা যায়। শুধু আর্থিক নীতি দিয়ে এ কাজ হবে না। সরকারের হাতে আরেকটি হাতিয়ার হবে টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি করে তা ন্যায্যমূল্যে বিতরণ করা। এই হাতিয়ারকে ব্যবহার করা উচিত। আশা করি, এদিকে নজর দেওয়া হবে। আরেকটি পদক্ষেপ হচ্ছে বাজার তদারকি এবং সেই আঙ্গিকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। এবার বোরো ফসল খুব ভালো হয়েছে এবং পাশাপাশি সরকারের ওএমএস কার্যক্রমও জোরদার করা হয়েছে। তাই চালের দাম কিছুটা কমে এসেছে। ওএমএসসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে চালের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে।
এবার রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়লেও বাড়ার হার আগের থেকে অনেক কম। এবার ৪ শতাংশ বেড়েছে, গতবার ছিল ১৯ শতাংশ। রেমিট্যান্স যেন আরও বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলির ওপর নজর রাখতে হবে এবং কয়েকটি দেশে নতুন গন্তব্য চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সুখবর হলো, মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর ব্যাপারে সমস্যা মিটে গেছে এবং নতুন নতুন গন্তব্যে জনশক্তি পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। দেখতে হবে যাতে জনশক্তিকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো যায়। এজেন্সির প্রতারণার হাত থেকে তাদের বাঁচাতে ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি।
সম্প্রতি ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়েছে। এর ফলে দুই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়—একদিকে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অর্থ পাওয়ার সুযোগ কমে যায়। সরকার যাতে পরিমিত পরিমাণে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। বৈদেশিক সহায়তা অধিক পরিমাণে ছাড় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সব শেষে ঠিকমতো বাজেট বাস্তবায়ন করার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। লক্ষ্য যতই ভালো হোক, বরাদ্দ যতই দেওয়া হোক, বাস্তবায়িত না হলে সুফল পাওয়া যায় না। কাজেই বছরের শুরু থেকেই কার্যকর উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ চাই।
পত্রপত্রিকায় দেখলাম, এবার এব লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট হতে যাচ্ছে। এই অঙ্ক ঠিক আছে বলে মনে করি। তবে বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হতে হবে। এবার বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২০ থেকে ২২ শতাংশ বাড়িয়ে ১১৮ লাখ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমান রাজস্ব আদায়ের ধারাবাহিকতায় সরকার তার কার্যক্রম জোরদার করলে এটা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে হয়। আর বাকি অর্থ আসবে ব্যাংক থেকে অথবা বৈদেশিক সহায়তা থেকে। এবার বাজেট ঘাটতি হবে জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ। এটা গ্রহণযোগ্য, এর বেশি হলেই সমস্যা।
পিপিপির সম্ভাবনা প্রচুর। তবে যেভাবে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে এখন পর্যন্ত হয়নি। সম্প্রতি বেশ কিছু প্রকল্প, বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাত পিপিপির আওতায় গৃহীত হয়েছে। আশা করি, এই প্রক্রিয়া আগামী বছর আরও জোরদার হবে এবং পিপিপির আওতায় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন যথেষ্ট সম্প্রসারিত হবে।
আমাদের উন্নয়ন বাজেটে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত বলে মনে করি কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি খাত। বর্তমান বাজেটেও এটা আছে, তবে আরও জোরদার করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ানো, ভর্তুকিসহ অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি কৃষিবহির্ভূত খাতগুলোর ওপরও বিশেষ নজর দিতে হবে। কিছু কিছু সরকারি কর্মসূচি—যেমন একটি বাড়ি একটি খামার, কর্মসৃজন ইত্যাদি—বিপুল সম্ভাবনা আছে, তবে এর বাস্তবায়ন আরও জোরদারভাবে করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ব্যবসা খাত বিষয়ে অনেক দিন থেকে কথাবার্তা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি তেমন হয়নি। এখানে যে বিপুল সম্ভাবনা আছে, তা কাজে লাগানো জরুরি।
নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে অনেক কর্মসূচি আছে যাদের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করতে হবে এবং এগুলো যাতে সঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির পর আমার বিবেচনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বর্তমানে আমরা জাতীয় আয়ের ২ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করি। এটা যৌক্তিকভাবে বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হলে অর্থ বরাদ্দ প্রচুর বাড়াতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগে তেমন অগ্রগতি হয়নি। তবে এখানে সরকারের নীতি রয়েছে যে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। এরপর জ্বালানি খাত বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। অনেকে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা জ্বালানি ঘাটতি। জ্বালানিবিষয়ক বেশ কিছু প্রকল্প ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে। এগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে এ ক্ষেত্রে উন্নতি হবে।
সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য, দেশে একটি অর্থনৈতিকভাবে সচল, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বাজেট একটি। সমাজ বিবর্তনের সব প্রক্রিয়ায় ওই লক্ষ্য বিধৃত করে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
কাজীখলীকুজ্জমান আহমদ: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, পিকেএসএফ।

No comments

Powered by Blogger.