চালচিত্র-বাজেট ও আমিষ by শুভ রহমান

প্রাক-বাজেট কথন শুরু হয়েছে। বাজেট আসছে। সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ কমবে কি! খুঁটিয়ে বাজার পরিক্রমা চলছে। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমিষ নাগালের বাইরে। ডিম, দুধ, মাছ, মাংস- সব আমিষই নাগালের বাইরে। পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দুর্ভোগ, পরিবহন খরচ, চিকিৎসাব্যয় ও বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার সার্বিক ব্যয় বৃদ্ধি


ক্রমবর্ধমান। এ অবস্থায় বাজেট আসছে। আশ্চর্য, সমাজটা কী রকম অনড় হয়ে আছে! মানিকবাবু লিখেছিলেন, 'মাছের লাজ ও মাংসের ঝাঁজ'। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের ঠিক আগে আগে কিংবা পরপরই। যুদ্ধের অনুষঙ্গ দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, ভয়াবহ সামাজিক আলোড়ন। তার মধ্যে মধ্যবিত্তের চরম দুঃখ-কষ্ট-দুর্ভোগের রূপকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন মাছের লাজ ও মাংসের ঝাঁজের কথা। মধ্যবিত্তের জীবনে তখনো আমিষ ছিল নাগালের বাইরে। রামপদ মণিকার অভাবক্লিষ্ট সংসারের মেয়ে বুড়া সবাই ঘাসপাতার তরকারি খেতে খেতে মুখ বাঁকিয়ে মাছ! মাছ! বলে প্রায় আর্তনাদ শুরু করেছিল। মাঝেমধ্যে মাছ এনে, কম দামের মাছ এনে ওজন আর দাম বাড়িয়ে বলে রামপদ তাদের শান্ত করার চেষ্টা করে এসেছে। আর মাংসের বেলা! একদিন কাকডাকা ভোরে রামপদ কাউকে কিছু না বলে নিজের হাতবাক্স হাতড়ে চুপচাপ বেরিয়ে গিয়ে আধসেরখানেক মাংস, আলু আর পেঁয়াজ কিনে ফিরে আসে। আর মণিকা বলে, 'এক ফোঁটা তেল নেই, ঘি নেই, কী দিয়ে মাংস রাঁধব? শুধু নুন দিয়ে সেদ্ধ করে দিলে খেতে পারবে?'
কত ওলটপালট হয়ে গেল সেই বিশ্বযুদ্ধের সময়কার পরে। দেশ ভাগ হলো, দু-দুবার দেশ স্বাধীন হলো, কত রাজনৈতিক উত্থান-পতন ঘটল, ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তানি জাতিগত নিপীড়ক গেল, সমাজ অনড়। একটা নিঃশব্দ, নেপথ্য যুদ্ধই যেন চলছে এখনো! আশ্চর্য, সমাজে সেই সীমিত আয়ের মানুষের আমিষের ক্রাইসিস রয়েই গেল।
সীমিত আয়ের, স্বল্প আয়ের, নিম্ন আয়ের মধ্যবিত্ত মানুষকে সেই এখনো লুকাতে হচ্ছে মাছের লাজ, সইতে হচ্ছে মাংসের ঝাঁজ। ছেঁটে ফেলতে হচ্ছে ছোটখাটো থেকে শুরু করে জীবনের সব চাহিদাই। আমিষের চাহিদা তার পরও পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ইট যেমন বিল্ডিং তৈরিতে লাগে, আমিষ তেমনি দেহের বিল্ডিং ব্লক। দেহ গঠন হবে কী দিয়ে! আমিষ নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সমাজ থেকে দেশ, জাতি- সব কিছুরই গঠনপ্রক্রিয়া ব্যাহত হতে বাধ্য।
পরিণামে মানস, মনন, মেধা আর সৃজনশীলতাও ক্ষুণ্ন হবে, আর গোটা জাতি পিছিয়ে পড়বে। আমিষ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে দেশ পরিচালক, রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্র পরিচালকদের ভাবতে হবে, নিশ্চেষ্ট, নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকা হবে আত্মঘাতী।
দেশের বাজেট, জাতীয় বাজেট সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত সীমিত আয়ের মানুষের জীবনের চাহিদাপূরণে ব্যর্থ হলে শুধু প্রতিটি সংসারই নয়, গোটা জাতিই পরিশেষে অচলাবস্থার সম্মুখীন হতে বাধ্য। মানুষের জীবন চলবে না, সংসার চলবে না, দেশও ঠিকমতো চলবে না, সামনে এগোবে না। এভাবে সাধারণ মানুষের চাহিদা অপূর্ণ রাখতে রাখতেই দেশকে বন্ধ্যা করে ফেলা হচ্ছে।
এখন একটা সময় এসেছে সব কিছু নতুন করে ভাবার। এবারের বাজেট স্পষ্টতই হবে শাসক মহাজোটের নির্বাচনী বাজেট। তিনটি বছর যেভাবে গোঁজামিল দেওয়া গেছে, এবার আর তা সম্ভব হবে না। সাধারণ মানুষের চাহিদাপূরণের কথা বাজেটে বিশেষভাবেই ভাবতে হবে। সর্বাগ্রে বাজারকে সহনীয় করতে হবে। মহাজোট সরকারের কাছে তো প্রত্যাশা ছিল মানুষের অনেক বেশি। তিন বছরেও সে প্রত্যাশা তেমন পূরণ করা যায়নি। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি-অনিয়মের রাহুগ্রাস, স্বজনতোষণ ঘুণপোকার মতোই সরকারের প্রশাসনের ভেতরটা কুরে কুরে খেয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা, সব কমিটমেন্ট, জনমানুষের কল্যাণচিন্তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। তার পরও এখনো মহাজোটের ভেতরে বেশ কিছু আদর্শনিষ্ঠ, দক্ষ, কমিটেড মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টায় শাসক মহাজোটের ঝুলিতে সাফল্যের হিরের টুকরো সঞ্চিত হয়েছে। অতি সাম্প্রতিক সাফল্যের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধে অবিশ্বাস্য, আশাতীত বিজয়, কয়েক জায়গায় বাপেক্সের নেতৃত্বে গ্যাসের সন্ধানলাভ, পাটের জেনোম আবিষ্কার, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকসহ পাশ্চাত্যে দাতা সংস্থাগুলোর বিরূপ মনোভাবের মুখে মালয়েশিয়ার বন্ধুসুলভ ও অনেক বেশি সম্মানজনক অর্থায়নের আশ্বাস, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জাতীয় শিক্ষানীতির মতো যুগান্তকারী শিক্ষা সংস্কার- এসব সাফল্য এতই অসামান্য যে এগুলোর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার অনায়াসেই শাসক মহাজোটের অন্য সব ব্যর্থতার গ্লানিমোচনে সক্ষম। শাসক মহাজোটের তাই প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ ও রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে হতোদ্যম হওয়ার কিছু নেই। সাধারণ মানুষের অবস্থা ধরে রাখার জন্য তাদের কল্যাণে একটি অর্থবহ বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে মহাজোট সরকার নিশ্চিতভাবেই দেশ, জাতি ও জনগণকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে।
প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদের দিকনির্দেশনা কাজে লাগিয়ে বিদেশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে 'ধার করে ঘি খাওয়ার নীতি' পরিহার করে সুবিবেচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ঋণ গ্রহণ এবং তার সদ্ব্যবহার করে সরকার দেশের বিদেশনির্ভরতা ক্রমে কাটিয়ে উঠতে পারে এবং স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে। মালয়েশিয়া, আফ্রিকার অনেক দেশ স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পক্ষান্তরে ভ্রান্ত নীতি গ্রহণ করে ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গ্রিস রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় নিপতিত হয়েছে। আমাদেরও বাজেট প্রণয়নে বিদেশনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে হবেই এবং সব অপচয়, ঋণের অর্থের অপব্যবহার ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়, দুর্নীতি, অনিয়ম কঠোরভাবে বন্ধ করেই মাত্র সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণকর অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আমিষের চাহিদাসহ সাধারণ মানুষের জীবনের সব চাহিদাই কেবল দুর্নীতি-অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলতামুক্ত প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব।
অতীতে প্রায় সব বাজেটেরই পেছনে ক্ষমতা ধরে রাখার দর্শনই কাজ করেছে। প্রকৃতপক্ষে জনকল্যাণকর বাজেটের দর্শন হওয়া উচিত নিছক ক্ষমতা ধরে রাখার বাজেট নয়, ক্ষমতার যৌক্তিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও সমাজের চলমান নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া রোধ করা নিশ্চিত করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন, যে সমাজে শুধু ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর হবে তা-ই নয়, সাধারণ মানুষ তথা জাতির আমিষের চাহিদাপূরণ নিশ্চিত হয়ে একটি উন্নত, আধুনিক, মেধাদীপ্ত, সৃজনশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার নিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে। কবে হবে তেমন বাজেট!

২.৪.২০১২

No comments

Powered by Blogger.