টঙ্গী-গাজীপুরে কিছু কারখানা বন্ধ by শরীফ আহমেদ শামীম ও মো. মাহবুবুল আলম

গাজীপুরের ভোগড়ায় ম্যানট্রাস্ট সোয়েটার কারখানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বামী পরিত্যক্তা এক নিটিং অপারেটর (৩৩) দুই মাস আগেও ওভারটাইমসহ মজুরি পেতেন ১০ হাজার টাকা। ঘরভাড়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ বাদ দিয়ে যা হাতে থাকত, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে যেত।


কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানার উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর মজুরি কমে যায় এক হাজার টাকা। মার্চ মাসজুড়ে তীব্র লোডশেডিং থাকায় উৎপাদন আরো কমে যাওয়ায় মজুরি কমে সাত হাজার টাকা দাঁড়ায়। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, 'গত দুই মাসে খাদ্যদ্রব্যের দাম ও অন্যান্য খরচ বেড়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে মজুরি কমেছে তিন হাজার টাকা। এ টাকায় সংসার কিভাবে চালাব।'
তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ও মজুরি কমে যাওয়ায় বিলকিছ বানুর মতোই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে গাজীপুর ও টঙ্গী শিল্প এলাকার কয়েক হাজার কারখানার লাখ লাখ শ্রমিকের। উৎপাদন ব্যাপক হ্রাস পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কারখানার মালিকরাও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহারের কারণে উৎপাদন খরচও খুব বেড়ে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় অর্ডার প্রস্তুত করতে দেরি হচ্ছে। সময়মতো শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। অনেক কারখানার মালিক ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করতে পারছেন না। লোকসানের মুখে ছোট ছোট বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অবস্থার উন্নতি না হলে লোকসান ও সময়মতো মাল সরবরাহ করতে না পারায় গার্মেন্ট শিল্পের বাজার বাংলাদেশের হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করছেন মালিকরা। লোডশেডিংয়ের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে জেলার কৃষিও। সেচের অভাবে হাজার হাজার একর জমির বোরো ফসল শুকিয়ে গেছে। জনজীবন গরমে বিষিয়ে উঠেছে।
টঙ্গী শিল্পাঞ্চলেও বিদ্যুতের লোডশেডিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কারখানাগুলো রপ্তানিপণ্য সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। কোনো কোনো কারখানা শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা চালিয়ে যেতে সমস্যায় পড়ছে।
গাজীপুরের বোর্ড বাজারের ওয়েসিস সোয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ কামাল জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে দেড় হাজার শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছেন। শীতে চার ঘণ্টা পর পর এক ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। এখন পুরোটাই উল্টো। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে, লোডশেডিং হয় চার ঘণ্টা। আগে জেনারেটরের জন্য দৈনিক পাঁচ হাজার টাকার ডিজেল লাগত। লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় এখন ডিজেল লাগছে ২৫ হাজার টাকার। আবার ডিজেলের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে জেনারেটর নষ্ট হচ্ছে ঘন ঘন। এতে মেরামত খরচ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, 'উৎপাদন কমে যাওয়ায় সময়মতো শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। কিন্তু সময়মতো শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে। অবস্থার উন্নতি না হলে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।' কামাল জানান, বিদ্যুতের অভাবে লোকসানের মুখে বোর্ড বাজারের ডেসিল ওয়্যার, গাছার এলএস ফুডসহ এলাকার বহু ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে শুনেছেন তিনি।
সদর উপজেলার কড্ডা এলাকার বডি লিংক ও বডি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হান্নান চৌধুরী বলেন, 'লোডশেডিংয়ের কারণে প্রতিষ্ঠান দুটির উৎপাদন অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। এ কারণে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
গাজীপুর পৌরসভার ইটাহাটা এলাকার দিগন্ত সোয়েটার কারখানায় কাজ করেন ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন জানান, আধা ঘণ্টা পর পর এক ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। দিনের ১০ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় সাত ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। এ জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠানে ডিজেল ও গ্যাস দুই ধরনের জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। চাপ না থাকায় গ্যাসের তিনটির মধ্যে দুটি জেনারেটরও ভালোভাবে চালানো যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সময়মতো মাল সরবরাহ করতে না পারায় বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।
গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ ওহিদুল ইসলাম জানান, জেলার সদর উপজেলায় টঙ্গী ছাড়াও একটি বিসিক শিল্পনগরী এবং ছোট-বড় কয়েক হাজার কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তা ছাড়া পুরো এলাকা শহর হিসেবেও গড়ে উঠেছে। সদরের ১৭৬ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে (টঙ্গীর হিসাব বাদ, টঙ্গীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ডেসকো) পাওয়া যাচ্ছে অর্ধেকেরও কম ৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ঘাটতি ৯১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে শ্রীপুরের সামিট পাওয়ার কেন্দ্র থেকে। বাকি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে পাওয়া যায়। তিনি জানান, গত বছর তাঁর সমিতির চাহিদা ছিল ১৬৯ মেগাওয়াট। সরবরাহ ছিল ৯০ মেগাওয়াট। এ বছর চাহিদা ছয় মেগাওয়াট বাড়লেও সরবরাহ না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে ৭৫ মেগাওয়াট করা হচ্ছে। তাই এ এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়। বাকি সময় শিল্প ও আবাসিক সব ক্ষেত্রে লোডশেডিং করা হচ্ছে।
ভয়াবহ অবস্থা শ্রীপুর শিল্প এলাকাতেও। বিদ্যুৎ না পেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে শ্রীপুরের মিতা টেঙ্টাইল। এতে বেকার হয়েছেন আড়াই হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। বন্ধ হওয়ার পথে ইয়ান ডায়িং, বিবি কেব্ল্স, সংকটে পড়েছে কাজী ও ফিনিক্স হ্যাচারি। সেচ দিতে না পারায় উপজেলার বরমী, গাজীপুরা ও মাওনা ইউনিয়নের হাজার হাজার বিঘা বোরো জমি শুকিয়ে চারা মরে গেছে।
নিজ মাওনা গ্রামের ফকিরবাড়ী পাড়ায় একটি গভীর নলকূপ পরিচালনা সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম মাস্টার বলেন, 'আগে এ গভীর নলকূপ চালানো হতো ডিজেল জেনারেটরে। বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার পর ওই জেনারেটর বিক্রি করে দেওয়ায় এখন আর জেনারেটরও ব্যবহার করতে পারছি না। সেচ দিতে না পারায় ফসলের মাঠ শুকিয়ে গেছে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই চলেছে।'
শ্রীপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর সভাপতি এস এম মাহফুল হাসান হান্নান জানান, শ্রীপুরে বিদ্যুতের চাহিদা ৫০ মেগাওয়াট। সামিট থেকে ১২ এবং জাতীয় গ্রিড থেকে এক মিলিয়ে পাওয়া যাচ্ছে ১৩ মেগাওয়াট, যা চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ। ঘাটতি ৩৭ মেগাওয়াট। তিনি বলেন, গত বছর শ্রীপুরে চাহিদা ছিল ৩৫ মেগাওয়াট। পাওয়া যেত ১৫ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ২০ মেগাওয়াট। এ বছর চাহিদা ১৫ মেগাওয়াট বাড়লেও সরবরাহ না বাড়িয়ে বরং দুই মেগাওয়াট কমানো হয়েছে।
টঙ্গীতে উৎপাদন হ্রাস
টঙ্গীর মেঘনা টেঙ্টাইল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রমিকরা বসে থাকছেন। বহুজাতিক ও বৃহৎ কিছু কারখানা নিজস্ব বিকল্প ব্যবস্থায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারলেও বেশির ভাগ কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো নির্ধারিত সময়ে পণ্য উৎপাদন ও জোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
শিল্প মালিকরা জানান, বিদ্যুৎ সংকটে তাঁরা কেউ কেউ নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালু রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তেলের দাম বারবার বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের উৎপাদন খরচ ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষুদ্রশিল্প মালিকরা অধিক ব্যয় বহনের চেয়ে উৎপাদন সময় কমিয়ে কারখানা চালু রাখার চেষ্টা করছেন।
টঙ্গীতে ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ডেসকো বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহের দায়িত্ব পায়। এ সময় ছোট, বড় ও মাঝারি শিল্প মিলিয়ে এক হাজার ৪০০ ও আবাসিক গ্রাহকসহ মোট বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল প্রায় ২৮ হাজার। বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ বৃহৎ এবং এক হাজার ২০০ ক্ষুদ্রশিল্প কারখানা রয়েছে। টঙ্গীতে বর্তমান ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হলেও বরাদ্দ রয়েছে ৭৪। তবে পাচ্ছে মাত্র ৪৭ মেগাওয়াট। গত রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি ছিল ২৭ মেগাওয়াট। মার্চ মাসজুড়ে গড়ে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল। ২৫ থেকে ৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত এখন লোডশেডিং চলছে প্রতিদিন। স্থানীয় পর্যায়ে লোডশেডিংয়ের সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের দেওয়া লোডশেডিং যুক্ত হয়ে আরো বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে। টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হওয়ার পর শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকট দূর হওয়ার আশা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুফল টঙ্গীতে পাওয়া যায়নি। বরং বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস টঙ্গীর সরবরাহ থেকে কমে গেছে। এতে নতুন করে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে।
টঙ্গী বিসিক শিল্প মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, ক্ষুদ্রশিল্প-কারখানাগুলো লোডশেডিংয়ের কারণে তীব্র সংকটে পড়েছে। অনেক কারখানার সাধ্য নেই ব্যয়বহুল বৈদ্যুতিক জেনারেটর ব্যবহার করার। বারবার তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রমিকদের বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন সচল রাখতে গিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে। শুধু রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পই নয়, রসায়ন, ওষুধ প্রস্তুতকারক, চামড়া, সিরামিক, স্টিল, খাদ্য, কাচ ও লৌহজাত শিল্পে বিদ্যুৎ সংকট উৎপাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। কখন লোডশেডিং শুরু হবে, তা আগে থেকে জানা না থাকায় পণ্য উৎপাদনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.