চট্টগ্রামে বেদখল অর্পিত সম্পত্তি-সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির কুফল

চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় সাড়ে আট হাজার একর অর্পিত সম্পত্তি এখনও বেদখল_ বৃহস্পতিবার সমকালের এ খবর সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসার সমস্যার খণ্ডচিত্র মাত্র। যাদের জমিজমা এভাবে সরকারের হাতে রয়েছে তারা যেমন দীর্ঘস্থায়ী অন্যায়ের শিকার, তেমনি সরকারও তার হাতে থাকা সম্পত্তির যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে


পারছে না। এটা কেবল অদক্ষতাজনিত নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই এর পেছনে রয়েছে জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে বঞ্চিত করার হীন চেষ্টা। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের হাতে থাকা সম্পত্তির একটি অংশ কোথায় কীভাবে রয়েছে, তার হিসাবও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের জানা নেই। 'অর্পিত সম্পত্তি' আইনের ইতিহাস যন্ত্রণাকর। ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের একটি অপরিণামদর্শী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক সিদ্ধান্তের কারণে এ দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিক তাদের সম্পত্তির মালিকানা হারায়। যুদ্ধের সময় 'শত্রু রাষ্ট্র ভারতে অবস্থান করেছে'_ কেবল এ অজুহাত দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেওয়া হয় এবং প্রশাসন ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের মর্জিমাফিক ইজারা প্রদান করা হতে থাকে। কোনো ব্যক্তি চিকিৎসা, শিক্ষা বা অন্য কোনো কারণে সে সময় ভারতে অবস্থান করলেই তার সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেওয়া হয়। তবে তা প্রয়োগ করা হতে থাকে কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান সরকারের এ সিদ্ধান্ত ছিল মৌলিক মানবাধিকার পরিপন্থী। পরবর্তী সময়ে এ ভূখণ্ডে অবস্থানকারী অনেকের সম্পত্তিও 'শত্রু সম্পত্তির' তালিকাভুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে আত্মাহুতি দিয়েছে, এমন শহীদ পরিবারের সম্পত্তিও এ তালিকায় রয়েছে। স্বাধীনতার পর শত্রু সম্পত্তির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'অর্পিত সম্পত্তি'। এ কালো আইনের অপপ্রয়োগ করা হবে না_ এমন প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের তরফে বারবার দেওয়া হয়েছে। 'অর্পিত সম্পত্তি' আইনে ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থ সংরক্ষণের পক্ষে রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের একাধিক নির্দেশনা। বর্তমান মহাজোট সরকার অর্পিত সম্পত্তির বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে সুরাহা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ কাজটি একতরফাভাবে করা হবে না, এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু সাড়ে চার দশকের বঞ্চনার অবসানে আর বিলম্ব অনুচিত। যারা অন্যায়ভাবে আমাদের দেশের নাগরিকদের একটি অংশের সম্পত্তি ভোগদখল করছে তারা এতে রুষ্ট হতে পারে, কিন্তু জয়যুক্ত হবে আইনের শাসন। সরকারের উচিত হবে শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চল নয়, দেশের যেসব স্থানে অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে তার তালিকা প্রকাশ এবং সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন ব্যক্তি কিংবা তাদের উত্তরাধিকারদের হাতে তা প্রত্যর্পণ করা। এ জন্য মূল্য নির্ধারণ করতে হবে যৌক্তিক হারে। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় যে সাড়ে আট হাজার একর অর্পিত সম্পত্তি বেদখল রয়েছে তা অবিলম্বে উদ্ধার করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, এটাই প্রত্যাশিত। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যারাই যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের অন্যান্য স্থানেও একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই। সরকারকে এটা মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি কখনও সুফল দেয় না, দিতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.