সেকেলে বেড়িবাঁধ আতঙ্কিত মানুষ by আব্দুল কুদ্দুস

আজ রোববার, ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ২১ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯১ সালের এই দিনে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল কক্সবাজার উপকূল। জলোচ্ছ্বাসে মারা গেছে ৯০ হাজার ৫৪৩ নারী-পুরুষ-শিশু। এর মধ্যে কুতুবদিয়ায় মারা যায় প্রায় ৫৭ হাজার, মহেশখালীতে ১২ হাজার ও চকোরিয়ায় ২১ হাজার মানুষ।


তবে এমন একটি ঘূর্ণিঝড় আবারও ঘটলে এলাকায় আরও ব্যাপক প্রাণহানীর আশঙ্কা স্থানীয় মানুষজনের।
বঙ্গোপসাগরের মাতারবাড়ি চ্যানেলে বেড়িবাঁধের ওপর ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন দিনমজুর আবদুল গফ্ফার (৪৫)। তিনি জানান, তিন বছর ধরে এই বেড়িবাঁধের ওপর ঘর বেঁধে বসবাস করছি। আসন্ন বর্ষার প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাসে এই ঘর বিলীন হয়ে যাবে, কিন্তু বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা কোথাও নেই।
আবদুল গফ্ফারের মতো মনির আহমদ, মো. গিয়াস উদ্দিন, রমিজ আহমদসহ ১২-১৪টি পরিবার এই নড়বড়ে বেড়িবাঁধের ওপর ঘরবাড়ি তৈরি করে চরম ঝুঁকি নিয়ে বসতি করছেন।
রমিজ আহমদের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৩৪) বলেন, ‘অন্য কোথাও বসবাসের ব্যবস্থা নেই বলে এই বাঁধে আমাদের জীবন বাজি রেখে বসত করতে হচ্ছে।’
কুতুবদিয়া বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি শাহরিয়ার চৌধুরী জানান, এখনো দ্বীপের ১৭ কিলোমিটার বাঁধ ভাঙা রয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, সদর, পেকুয়া উপজেলার ৪৬০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। তার মধ্যে ৫৮ কিলোমিটার বাঁধের কোনো চিহ্নই ছিল না। ’৯১ সালের পর ২১ বছর পার হলেও ৪০ কিলোমিটারের বেশি বেড়িবাঁধ এখনো ভাঙা।
পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মইনুদ্দীন জানান, বিভিন্ন সময় বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে ভাঙা বেড়িবাঁধগুলো নির্মাণ করা হলেও ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নানা দুর্যোগে তা আবার তলিয়ে যাচ্ছে। এখন টেকনাফ, কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে।
মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ জানান, দ্বীপের ১৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙা, নেই পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। এই ইউনিয়নে ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে বর্তমানে আটটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সংশিষ্ট সূত্র জানায়, জেলার আটটি উপজেলার বিভিন্ন উপকূলে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর তৈরি করা হয় ৫৩৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র।
এর মধ্যে ১৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
কুতুবদিয়া বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি শাহরিয়া চৌধুরী জানান, বর্তমানে ২২টি আশ্রয়কেন্দ্র মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আরও ৫০টির বেশি কেন্দ্র অবৈধ দখলে চলে গেছে।
মহেশখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে এই উপজেলায় ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। উপজেলার ১২৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭০টির বেশি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
বাড়ছে দুর্যোগ, শঙ্কিত জনগণ : আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান জানান, ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০০৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চারবার (১৯৯৫, ১৯৯৭, ২০০০ ও ২০০১ সালে) ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে কক্সবাজার উপকূলে বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগর ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে। ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ছয়টি ঘূর্ণিঝড়সহ ১১৭টি লঘু ও নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে দুবার। তা ছাড়া বঙ্গোপসাগরে পানির তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় উপকূলীয় অঞ্চল ক্রমান্বয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এ কিউ এম মাহবুব জানান, সাধারণত এপ্রিল, মে, জুন এবং সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ ও নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে।

No comments

Powered by Blogger.