চিরকুট-তিউনিসিয়ার স্মৃতি by শাহাদুজ্জামান

টিভির পর্দায় তিউনিস শহরের হাবিব বারগুইবা এভিনিউয়ে বিক্ষোভরত হাজার হাজার মানুষের ছবি দেখে স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়ি। দুই পাশে চমৎকার সবুজ গাছের সারি ঘেরা ওই এভিনিউয়ে ফুরফুরে হাওয়ায় হেঁটে বেড়িয়েছি মাস ছয়েক আগে। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণায় যুক্ত থাকার সুবাদে নানা দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়।


সুযোগ হয়েছিল তিউনিসিয়ায় যাওয়ারও। তিউনিসিয়া সচরাচর বিশ্বসংবাদের আলোচিত কোনো দেশ নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগও সে দেশের বিশেষ নেই। ফলে দেশটি সম্পর্কে জানাশোনাও ছিল কম। অনেক কিছুই জানা হয়েছিল দেশটিতে যাওয়ার কল্যাণে। তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগ থেকে শুরু করে এমন একটি নাটকীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটবে, তেমন পূর্বাভাস ছিল না মাস ছয়েক আগেও। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের ভেতর যে তুষের আগুনের মতো একটি চাপা ক্ষোভ জ্বলছে, সেটি টের পেয়েছিলাম তখনই।
রাজধানী তিউনিসে গিয়ে ছিমছাম শহরটির প্রাণচাঞ্চল্য মন কেড়েছিল। মুসলিমপ্রধান দেশ, কিন্তু জীবনযাপন ও পোশাক-আশাকে পাশ্চাত্যের প্রভাব ব্যাপক। চোখে পড়েছিল জনজীবনে মেয়েদের সপ্রতিভ চলাচল, দৃশ্যমান অংশগ্রহণ। মসজিদের আজান যেমন শোনা যাচ্ছিল, শোনা যাচ্ছিল গির্জার ঘণ্টাও। হাজার বছর আগে আফ্রিকায় রোমান সাম্রাজ্যের যে প্রধান কেন্দ্র ছিল তিউনিসিয়া, তার ছাপ রয়ে গেছে এখনো। রোমানদের পর আরবদের অধীন হয়েছিল তিউনিসিয়া, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলাম। তিউনিসিয়ায়ই জন্ম নিয়েছিলেন অন্যতম মুসলিম চিন্তাবিদ ইবনে খালদুন। বারগুইবা এভিনিউয়ের এক প্রান্তে ইবনে খালদুনের যে বিশাল ভাস্কর্যটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম, টিভিতে দেখলাম সেখানে আর্মির ট্যাংক। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরবি দেশের প্রধান ভাষা হলেও তাদের এককালীন ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষা ফরাসির ব্যবহারও রয়েছে ব্যাপক। আরবদের হটিয়ে তিউনিসিয়া দখল করে নিয়েছিল তুরস্কের অটোমানরা এবং তাদের হটিয়ে তিউনিসিয়াকে দখল করেছিল ফ্রান্স ১৮৮১ সালে। দীর্ঘ ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের পর ১৯৫৭ সালে হাবিব বারগুইবার নেতৃত্বে স্বাধীন হলো তিউনিসিয়া। জানলাম, হাবিবকে হটিয়ে তাঁরই মন্ত্রী সামরিক অফিসার আবেদিন বেন আলী ১৯৮৭ সালে দেশটির ক্ষমতা নিয়েছিলেন। তার পর থেকে তিনিই দেশটির একচ্ছত্র অধিপতি। তিউনিসিয়ার গ্রামজীবন আর এক নারীর সংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার লুই বার্তুচেলির অসাধারণ ছবি রামপার্টস অব ক্লে দেখেছিলাম আশির দশকে। বলা বাহুল্য, রাজধানী তিউনিসে সে দারিদ্র্যের কোনো চিহ্ন নেই। তিউনিসিয়ান সহকর্মী নারী গবেষক ফাতেন তিলি শহরটি ঘুরে দেখিয়েছিলেন আমাকে। শহরজুড়ে বিপণিবিতান, বিলাসবহুল হোটেল, পানশালা, আধুনিক গাড়ি। ফাতেন বলছিলেন, জাঁকজমক যা, তা এই তিউনিসেই—প্রাদেশিক শহরগুলোয় আছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব। ফাতেনের সঙ্গে গিয়েছিলাম শহরের অদূরে সিদি বুসাঈদ এলাকায়। পাহাড়ের ওপর এই ছোট্ট লোকালয়টিকে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। একদিকের অবারিত নীল সমুদ্রের প্রেক্ষাপটে এলাকার প্রতিটি বাড়ির রং সাদা, দরজা-জানালাগুলো গাঢ় নীল। এমন অভিনব চিত্ররূপময় লোকালয় সম্ভবত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। বহু বিশ্বখ্যাত লেখক, চিত্রকর দীর্ঘসময় কাটিয়ে গেছেন এই লোকালয়টিতে। এসেছিলেন লেখক ফ্লবেয়ার, চিত্রকর পল ক্লি। সমুদ্রের হাওয়ায় ওই নীলাভ সিদি বুসাঈদের এক ক্যাফেতে বসে ফাতেনের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডার স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে মনে। ধ্রুপদি সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠিকা ফাতেন। তাঁর মতো এমন ঘোর নারী ধূমপায়ী দেখিনি আগে। ঠোঁটের ডগায় অবিরাম সিগারেট চেপে আমাকে শোনাচ্ছিলেন দস্তয়ভস্কি আর বালজাক নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস। তিউনিসিয়ার রাজনীতি নিয়ে আলাপ তুলতেই খানিকটা নিচু গলায় ফাতেন বেন আলী সরকার নিয়ে হতাশা, ক্ষোভ আর ক্রোধের কথা জানিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন দেশে বিরাজমান ব্যাপক দুর্নীতির কথা। বলেছিলেন, তিউনিসিয়ার মানুষের ভেতর ব্যাপক আক্রোশ জমা হয়ে আছে, কিন্তু বলার সাহস নেই। কঠোর পুলিশি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সব জায়গায়। জানতে চেয়েছিলাম, কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখেন কি না। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে নীল ভূমধ্যসাগরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন ফাতেন; বলেছিলেন, পরিবর্তন আসতে হবেই, কিন্তু কবে সেটা ঘটবে, তা তাঁর জানা নেই।
এত দ্রুত দেশে এমন যুগান্তকারী একটি ব্যাপার ঘটে যাবে, তা তিউনিসিয়াবাসীর কাছেও ছিল অবিশ্বাস্য। বেকার মুহামেদ বুয়াজিজিকে রাস্তায় তরকারি বিক্রি করতে পুলিশ বাধা দিলে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেন তিনি। এ আগুন যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। চেপে থাকা তুষের আগুন জ্বলে ওঠে বারুদের মতো। মাত্র সপ্তাহ খানেকের ঘটনাবলিতে একনায়ক বেন আলী দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ঘটনার প্রভাবে হয়তো একেক করে পতন ঘটতে পারে লিবিয়া, আলজেরিয়া, সৌদি আরব ও মিসরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনেরও। এক বেকার তরকারি বিক্রেতা হয়তো নিজের অজান্তে আরব বিশ্বে এক নতুন যুগের সূচনা করে দিলেন।
আরও দেখা গেছে, তিউনিসিয়ার এই ত্বরিত বিপ্লবে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে ইন্টারনেট। তরুণেরা ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে তথ্য, ছবি চালাচালি করে নিজেদের মধ্যে আন্দোলন সমন্বয় করেছেন। ইতিমধ্যে উইকিলিকসেও তিউনিসিয়ার দুর্নীতি, প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর নানা স্বেচ্ছাচারিতার খবর ফাঁস হওয়ার ব্যাপারটিও ভূমিকা রেখেছে এই ব্যাপক বিক্ষোভে। এই ডিজিটাল যুগে ইতিহাসের পটপরিবর্তনের ধরন, নিয়মাবলি পাল্টাচ্ছে। কখন, কীভাবে, কোন জায়গা থেকে সমাজব্যবস্থার ওপর আঘাত আসবে, এর পূর্বাভাস দেওয়া হয়ে পড়ছে কঠিন। তবে একটি নিয়ম আছে অপরিবর্তিতই। জনগণকে বঞ্চিত করলে, তাদের নির্বোধ বিবেচনা করলে—আঘাত অবধারিতভাবে আসবে সেখান থেকেই। আর এই প্রযুক্তির যুগে সেই আঘাত হবে অভিনব, দ্রুত ও তীব্র।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@Yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.