সমাজ-শিক্ষার যে চেহারাটা আমরা দেখি না by মোহীত উল আলম

দিন দিন শিক্ষক হিসেবে আমি যত বুড়ো হচ্ছি, তত যেন নতুন নতুন জ্ঞান লাভ করছি শিক্ষার চরিত্র আর উদ্দেশ্য নিয়ে। একটি ছাত্র এসে দাঁড়াল আমার কামরার সামনে। খুব বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ঢুকতে অনুমতি দিলাম। আমার একটি কোর্সের ছাত্র। খুব নিয়মিত। কিন্তু লেখাপড়া কিচ্ছু পারে না।


চোখ মুছতে মুছতে বলল, তাকে কোনোমতে পাস নম্বর দেওয়া যায় কি না। বললাম, সেটা সম্ভব নয়। কোর্সটা বরং তাকে রিটেক বা ফিরতি নিতে হবে। তখন সে যা বলল তাতে আমার কাছে অজানা এক পৃথিবী খুলে গেল। সে বলল, সে গরিব কৃষক বাবার ছেলে। কিন্তু তার চাচারা মোটামুটি অবস্থাপন্ন। তাদের পরিবার থেকে সে-ই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। তার লেখাপড়ার খরচ তার বাবা তার চাচাদের কাছ থেকে জোগাড় করছেন একটি শর্তে। যখন সে একদিন শিক্ষিত হয়ে উপযুক্ত হবে, তখন তার চাচাতো ভাইবোনদের (যারা এখন ছোট) পড়াশোনার দায়িত্ব তাকে নিতে হবে। এখন পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে শুনলে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। কঠিন শর্ত।
মনে পড়ল, কানাডায় পড়াশোনা করার সময় যখন আমার বিভাগের অধ্যক্ষকে আমাকে কিছু ফান্ড বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলাম, যাতে আমি আমার স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে যেতে পারি, তিনি বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা তাঁদের বিবেচনার বিষয় নয়। এ ছেলেটিকেও অনেকটা ঘুরিয়ে তাই বললাম। বললাম, রবার্ট ব্রুসের লাইনে, ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ বললাম, ‘তোমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনই খোলা আছে। রিটেক নাও।’
ছেলেটি রাজি হলো, যদিও চোখ মুছতে মুছতে আমার কক্ষ ছাড়ল। তাকে আবার ডেকে বললাম, শোনো, মন খারাপ করার কিছু নেই। ভালো ছাত্র-খারাপ ছাত্র বলে কোনো কথা নেই। তুমি যদি চেষ্টা করো, তুমিও পারবে ভালো করতে।
ইন্টারনেট, ই-মেইল, ফেসবুক ও মোবাইল প্রযুক্তির কারণে গত দুই দশকে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ অনেক বেড়ে গেছে। শ্রেণীকক্ষের বাইরেও শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রচুর উদ্দীপনামূলক কথা বলতে হয়। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা শুনতে হয়। সমস্যা থেকে উত্তরণ পাওয়ার জন্য তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে প্রচুর কথা ওয়াজের মতো করে বলতে হয়। শিক্ষক এখন আর আগের মতো শ্রেণীকক্ষভিত্তিক নন, তিনি প্রায় দ্বিতীয় অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
সে জন্য, আমার ছাত্রটি বিদায় নিলে, আমি তার বাইরে গিয়ে তার পরিবারের মধ্যে আমার চিন্তাকে প্রতিস্থাপন করলাম। তার বাবার কথা ভাবলাম। একটি দুঃখী কৃষক পরিবার, শিক্ষার আলো পেতে চাইছে। বাবা চাইছেন তাঁর ছেলে লেখাপড়া শিখে সুসন্তান হোক। তিনি শিক্ষার মর্যাদা বুঝেছেন আদর্শিক অর্থে, আর শিক্ষার গুরুত্ব আর কার্যকারিতা বুঝেছেন বাস্তব অর্থে। সে জন্য বাপ ছেলেকে কৃষিকাজ থেকে ছাড়িয়ে শিক্ষার পথে পাঠিয়েছেন।
পাঠকের মনে এরই মধ্যে কৃষিকাজ বনাম শিক্ষা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে বুঝতে পারছি। বদরুদ্দীন উমরের একটি কলামে পড়েছিলাম যে যখন তিনি কৃষক-রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন, তখন তাঁকে এক নিরক্ষর চাষা বলেছিলেন, তাঁরা শিক্ষিত না হলেও মূর্খ নন। তাঁদের শিক্ষাটা অন্য রকমের। অর্থাৎ, কৃষিকাজও একটা শিক্ষা, যেটা বিএ-এমএ পাস করলেও শেখা যায় না। কথাটা অবশ্যই সত্যি, কারণ বছিলা রোডের যে গাড়ির কারিগর বছর ত্রিশেক বয়সের মনা মিস্ত্রির কথা বছর খানেক আগে প্রথম আলোর একটি কলামে লিখেছিলাম, তাঁর মতো ম্যাজিশিয়ান গাড়ির কারিগর একজন পাস করা মোটর প্রকৌশলীর পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়।
তার পরও এখানে একটা ব্যাপার আছে দেখার। সেটা হলো, হাতের কাজের শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমকক্ষ হতে পারে না। ভালো চাষি, ভালো কারিগর, ভালো জেলে, ভালো তাঁতি...তাদের সবারই নিজ নিজ কাজে নিপুণ দক্ষতা আছে...এবং এসব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, কিন্তু যে শিক্ষা না থাকলে এদের কর্তৃত্ব বাড়ে না, এদের মুখের জবান কেউ শোনে না, সেটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। মানুষ সহজাতভাবে কর্তৃত্বপরায়ণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের ফলে মানুষ যখন চাকরিপ্রাপ্ত হয়, তার ফলে তার একটা কর্তৃত্ব লাভ হয়, সে ধাপে ধাপে ওপরে উঠে একটা ক্ষমতাধর অবস্থানে পৌঁছায়। শিক্ষার সনদের জোরে চাকরিপ্রাপ্তি, এর ফলস্বরূপ কর্তৃত্বশীল ও ক্ষমতাবান হওয়া এবং এ দুটোর সহযোগে (মূলত অবৈধ পথে) অর্থবান হওয়া—সন্তানের জন্য এ রকম একটি জীবনাচরণ যে ১০০ বছর ধরে আমাদের সমাজে অভিভাবকদের দ্বারা আদৃত হয়ে আসছে, সে স্বপ্ন থেকে আমার ছাত্রের কৃষক বাবাও মুক্ত নন। একজন চাষির চাষ-সম্পর্কিত শিক্ষা যেখানে তাঁর জমি বা গোলার রক্ষণাবেক্ষণের কার্যকারিতার মধ্যে ফুরিয়ে যায়, সেখানে একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণকারী লোক হয়তো কৃষি অফিসার হয়ে দশ গ্রামের চাষবাসে শিক্ষিত কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে নিরক্ষর চাষির ওপর ছড়ি ঘোরায়। কৃষি অফিসারের এ ক্ষমতা গ্রামাঞ্চলের সাধারণ নিরক্ষর কিন্তু চাষবাসে শিক্ষিত চাষিদের চোখে উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়ে। আমাদের দেশের চালু কথাটা আছে না যে, বাবা-মা চায় ছেলে জজ-ব্যারিস্টার হোক? অর্থাৎ, ছেলে (বা মেয়ে) ক্ষমতাবান বা পয়সাওয়ালা হোক।
‘জ্ঞানই শক্তি’ বলে যে কথাটা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দেয়ালগাত্রে সবিশেষ উৎকীর্ণ থাকে, এর মধ্যে যে মেধার চর্চার কথাটা নিহিত আছে, তার প্রতি সাধারণভাবে সাধারণ মানুষ আকর্ষিত হয় না, মানুষ আকর্ষিত হয় ‘শক্তির’ আক্ষরিক অর্থটিতে, অর্থাৎ ‘জ্ঞানই ক্ষমতা’ বা ‘শিক্ষাই ক্ষমতা’—সেটার প্রতি। ‘ষোল আনা মিছে’ বলে যে বিখ্যাত কবিতাটিতে গ্রহ-নক্ষত্রের ঠিকুজি জানা পণ্ডিত ব্যক্তিটিকে নদীতে ঝড় সামলানোর অছিলায় একজন নৌকার মাঝির সাঁতার জানার দক্ষতার কাছে উপহাসের পাত্র করে তোলা হয়েছে, সে কবিতাটা, আমরা যদি সাধারণ মানুষের শিক্ষাবিষয়ক মনোবাঞ্ছা কিছুমাত্র বুঝে থাকি, তাহলে বুঝব যে সেটি বাস্তবসম্মত কবিতা হয়নি। কেননা, কোনো নৌকার মাঝি প্রকৃত অর্থে একজন শিক্ষিত লোককে উপহাস করবে না।
একজন নগরচেতনাধারী কবির মনে হতে পারে যে গ্রামের অশিক্ষিত লোকজন বুঝি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত লোকদের উপহাস করে, কিন্তু এর প্রমাণ সমাজে পাওয়া যায় না। কারণ, যে মাঝি বা কৃষকের ঘরে তিন পুরুষ ধরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চর্চা হয়নি, দেখা যাবে যে চতুর্থ প্রজন্মে এসে হলেও সে ঘরে শিক্ষা ঢুকেছে। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পর কর্তৃত্ব, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা আর অর্থ উপার্জনের খোলা রাস্তাটি একসময় না একসময় ওই কৃষক বা মাঝি দেখবে। যেমন দেখেছেন আমার ছাত্রের বাবা। সমাজের বনেদি লোকেরা প্রায় মুখে মুখে বলে থাকেন, অমুক লোক আজকে বড় হলে কী হবে, তার বাবা (বা দাদা) তো চাষা ছিল বা গরুর গাড়িওয়ালা ছিল। কিন্তু আসলে অবস্থানগত এ রূপান্তরের পেছনে লুকিয়ে আছে লেখাপড়ায় শিক্ষিত করে ছেলেকে ভদ্রলোকে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন। শিক্ষার সঙ্গে সামাজিক অহমিকাবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমি চট্টগ্রামের যে পাড়ায় শিশুকাল থেকে বড় হয়েছি, সেটি পাঁচমিশেলি কিন্তু খুব জঙ্গম একটি পাড়া ছিল। অল্প কয়েকটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার ছিল সেখানে, আর বাকি পরিবারগুলো ছিল ধনাঢ্য কিন্তু শিক্ষার প্রতি উদাসীন সওদাগর পরিবার, আর বিভিন্ন নিম্নবিত্তের পেশার লোক যেমন কসাই, ডেকোরেটর, ধোপা, নাপিত, পিয়ন, তরকারিওয়ালা ও রিকশা-বেবিট্যাক্সিওয়ালার পরিবার। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করার মতো ছিল যে, এঁরা সবাই তাঁদের সন্তানদের শিক্ষিত পরিবারগুলোর সন্তানদের মতো স্কুলে পাঠিয়ে লেখাপড়া গ্রহণের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছিলেন। ফলে আজকে দেখি এ সন্তানদের অনেকে শিক্ষিত হয়ে সমাজে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পথ বেছে নেওয়ার প্রবণতা মানুষের সহজাত। এ জন্য বাংলাদেশে শিক্ষার হার দ্রুত বাড়ছে।
আরেকটি প্রশ্নের উত্তর না দিলে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারটা এত জরুরি ছিল না, সেই দুই প্রজন্ম আগেও দেশে ধনিক শ্রেণী ছিল। প্রচুর পরিমাণে বিত্তও ছিল তাদের। চট্টগ্রামের একজন ধনী সওদাগরের বাসগৃহে সেই পাকিস্তান আমলে সুইমিং পুল পর্যন্ত ছিল। চট্টগ্রামের কিছু ব্যবসায়ী এলাকায় বকলম সওদাগরেরা টিপসইয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এবং সমুদ্র উপকূলসংলগ্ন চোরাচালান ও মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে প্রচুর অশিক্ষিত লোক এক প্রজন্ম আগেও কোটিপতি হয়েছেন, যে জন্য ইংরেজিতে চালু আছে এ কথাটা যে, ‘দ্য ফার্স্ট মিলিয়নিয়ার ইজ আ ডার্টি মিলিয়নিয়ার’। কিন্তু এদের সন্তানেরা দেশে এবং বিদেশে লেখাপড়া করে শুধু যে পিতৃসম্পত্তির পাহারাদার হয়েছে তা নয়, পিতার ব্যবসা বাড়িয়ে সামাজিকভাবেও প্রতিপত্তিশালী হয়েছে। পিতার দিক থেকে এটাই ছিল সন্তানের প্রতি কাম্য। আমাদের সমাজটা মোটামুটি টাকাশাসিত সমাজ। সে অর্থে অশিক্ষিত পরিবার শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষিত, ক্ষমতাবান ও অর্থশালী হয়ে ওঠার রেওয়াজটা এখন সার্বিকভাবে গৃহীত রেওয়াজ। অর্থাৎ, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণ একজন অশিক্ষিত ধনবান পিতার মধ্যে যেমন, তেমনি একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকের মধ্যেও জাগরূক। আমরা পছন্দ করি আর না করি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি এই বৈষয়িক আগ্রহ এখন বাংলাদেশের শিক্ষা গ্রহণের প্রধান চরিত্র।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.