মাদক-সর্বগ্রাসী আত্মবিধ্বংসী উপাদান by তাজনাহার নাজমুল

মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার মারাত্মক সমস্যা। মানুষ বংশগতভাবে অপরাধী নয়, তেমনি কোনো মানুষ বংশগতভাবে মাদকাসক্তও নয়। পরিবেশ, পারিপাশর্ি্বকতা ও অন্যান্য আর্থ-সামাজিক অনুষঙ্গ তাকে মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দেয়। অনেক সস্তা পারিবারিক ও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ মানুষকে মাদকের অক্টোপাসে জড়িয়ে ফেলে।


মূলত অজ্ঞতা ও কৌতূহল থেকেই মানুষ মাদকাসক্ত হয়। অজ্ঞ তরুণরা মাদক সেবনকে বিলাসিতা বা উপভোগ্য মনে করে। আমাদের অনেক তরুণ নেশার কারণে মাদক সেবন করে না। তাদের উদ্দেশ্য থাকে মাদক সেবনের মাধ্যমে নতুন অনুভূতি জাগ্রত করা। বিশেষ করে ফেনসিডিলে আসক্তদের মধ্যে এটা কাজ করে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছাত্ররা মূলত কৌতূহল থেকে দল বেঁধে তা স্পর্শ করে এবং নেশার ছোবলে আটকে পড়ে। পরে সচেতনতা ফিরে এলেও আসক্ত ব্যক্তি মাদকের অনতিক্রান্ত বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়।
ফেনসিডিল ও কফ সিরাপ হিসেবে ব্যবহৃত সিডাকসিনে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ অ্যালকোহল প্রচলিত ওষুধ আছে। ফলে জাতীয় ওষুধনীতিতে তা বন্ধ হলেও ভারত থেকে বিপুল পরিমাণে আসছে অবৈধ ব্যবসায়ীদের হাত দিয়ে।
ক্রমাগত ফেনসিডিল সেবনের ফলে দৈহিক অবসন্নতা, চিন্তাশক্তির স্থূলতা, কর্মস্পৃৃহা হ্রাস, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে প্রজনন শক্তি বিনষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটায়। প্যাথেডিন ঘুম উদ্রেককারী ও অচেতন অবস্থা সৃষ্টিকারী একটি ইনজেকশন। এটি আন্তঃশিরা প্রয়োগের একটি ইনজেকশন। প্যাথেডিনে আসক্তরা শিরা এবং ধমনিতে এ ইনজেকশন ব্যবহার করে। এটি গ্রহণ করার পর শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারাদেহে ছড়িয়ে যায়। ফলে আসক্ত ব্যক্তির সারাদিন ঘুম ঘুমভাব, ক্ষুধামন্দা ও কর্মের প্রতি এক ধরনের বিরূপতা দেখা দেয়।
মানুষ সামাজিক ও মনস্তাত্তি্বক কারণে মাদকাসক্ত হয়। সেগুলোর মধ্যে আছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও অশান্তি এবং কর্মসংস্থানজনিত হতাশা। ক্রমাগত আসক্তি মানুষকে এক ধরনের অপরাধপ্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়। ফলে এরা ক্রমান্বয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তারা আক্ষরিক অর্থে হয়ে পড়ে প্রায় এক প্রকার অন্ধকার জগতের বাসিন্দা।
ভাং, গাঁজার সঙ্গে হেরোইন, মারিজুয়ানা, চরস, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল ও তামাক সোনার দামে বেচাকেনা চলে। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের ফলে সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বর্তমানে খুবই উদ্বেগজনক। সিগারেট থেকে ক্যান্সার ও হৃদরোগ অকালমৃত্যু ডেকে আনে। হেরোইন ও কোকেন শরীরে পুশ করার জন্য ব্যবহৃত ইনজেকশনের সুই এইডসের বিস্তার ঘটায়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদকাসক্তি ভীষণ ক্ষতি করছে। সম্ভাবনাময় তরুণ সম্প্রদায় এভাবে পরিণত হচ্ছে প্রতিশ্রুতিহীন।
মাদকাসক্তি সমাজের জন্য নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর। ধূমপান থেকে হৃদরোগ, ক্যান্সার, পেপটিক আলসার, উচ্চ রক্তচাপ রোগের সৃষ্টি হয়। ধূমপানে নিকোটিন, নেপথালন, ফেনল, নাট্রাস, অ্যামানাইস, হাইড্রো কার্বন প্রভৃতি বিষাক্ত পদার্থ থাকে। গত ১০ বছরের ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। এর কারণ ধূমপানে আসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধি। ধূমপানের সঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সারের একটি যোগসূত্র আছে। আগে শুধু পুরুষদের মধ্যে এ রোগ ছিল। কিন্তু এখন পশ্চিমা দেশগুলোর পুরুষ ও মেয়েদের ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রবণতা সমান। যেসব মহিলা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ধূমপান একসঙ্গে চালায়, তাদের উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের আশঙ্কা থাকে বেশি। গর্ভধারণে এ প্রভাব মারাত্মক। ধূমপায়ী মায়েদের সন্তানের ওজন অধূমপায়ী মায়েদের সন্তানের চেয়ে ১৭০ গ্রাম কম। ধূমপান জরায়ুতে ভ্রূণের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ফলে গর্ভ ফুলে রক্ত ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না। ধূমপায়ী মায়েদের গর্ভপাত জরায়ুতে ভ্রূণের অপরিণত মৃত্যু ঘটায়। ধূমপায়ী মায়েদের সন্তান অধূমপায়ী মায়েদের সন্তানদের চেয়ে কম বু্িদ্ধমান হয়।
এ পর্যন্ত যেসব সূক্ষ্ম উপাদানের মিশ্রণ ঘটেছে তার মধ্যে স্নায়ুতন্ত্র সবচেয়ে বেশি মনকে বেঁধে রাখার রাসায়নিক উপাদান সমষ্টি। প্রতিটি চিন্তা, ভাবাবেগ, স্মৃতি স্নায়ুতন্তুর সাহায্যে পরিসঞ্চালিত হয় এবং তার মাধ্যমে মস্তিষ্কে ও স্নায়ুকোষের মধ্যে সংকেত পাঠায়। ধূমপানে আসক্ত ব্যক্তির মনে সংযম ও আত্মশক্তির উদ্বোধন দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। মানুষের সচেতনতা দিয়ে ব্যক্তির পদতলে নেশাকে পদদলিত করে ক্ষতিকর ও ব্যয়বহুল নেশার বিরুদ্ধে মানসিক শক্তির দেয়াল তুলে ধরা সম্ভব। তাহলে ধূমপানমুক্ত বিশ্ব বাস্তবায়ন সম্ভব। সুদৃঢ় মনোবল ও তীব্র সচেতনতাই মুক্তির পথ দেখায়। সে জন্য মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণী বা বয়স্ক ব্যক্তিকে অত্যন্ত যত্ন এবং দায়িত্বের সঙ্গে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিকতা ও সুস্থতার পথে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে মাদকাসক্তের প্রতি ঘৃণা, অবজ্ঞা বা উপেক্ষা ক্ষতির কারণ হয়। মাদকাসক্তির ছোবল থেকে বৃন্তচ্যুত হওয়ার আগে সতর্কতার সঙ্গে পথে আনার চেষ্টা চালাতে হবে। ব্যাপক প্রচারণা ও সংঘবদ্ধ আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আত্মঘাতী মাদকবিরোধী ও মাদকবিনাশী কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাফায়েল বিয়োজের কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। তিনি নিউইয়র্ক সিটির মাদকাসক্তদের এলাকা দক্ষিণ ব্রোনক্সে একটি গৃহায়ন প্রকল্পে বড় হন। তার বাবা অত্যধিক অ্যালকোহল পানের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ বছর পর্যন্ত তিনি এ জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। তার যখন ৩১ বছর বয়স তখন তিনি অন্য জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হন এবং মর্যাদাসম্পন্ন ফার্মে যোগদান করেন। তারপর তিনি সর্বদাই গোপনে দিনে একবার গুলি ছোড়ার স্থান পরিদর্শন করতেন। তার প্রিয় আসক্তি ছিল কোকেনের সঙ্গে হেরোইন মিশিয়ে ব্যবহার করা। দশ বছর আগে বিয়োজ চিরতরে তার বদভ্যাস পরিত্যাগ করেন নিজের চেষ্টায়। তিনি এখন শিকাগোভিত্তিক মাদকাসক্তি নিরাময়ের একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তিনি মাদকাসক্ত হয়ে আবার নীতি-নৈতিকতাবোধে উজ্জীবিত হয়ে বেঁচে আছেন। এ ক্ষেত্রে ডোপামন একটা ভূমিকা পালন করেছিল। যদিও তা একেবারে বিতর্কিত নয়। আমাদের দেশে বারবা হাসপাতাল এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তাজনাহার নাজমুল : ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.