এই সমাজ-নারীর প্রজনন কর্মভার by রোকেয়া কবীর

নারীর প্রতি বিদ্যমান সনাতনী সমাজ ব্যবস্থায় নারী সমাজকে যে পরিমাণ অমানবিক অবস্থার ভেতর দিয়ে জীবনধারণ করতে হয়, সে অবস্থার পরিবর্তন করা না গেলে সমাজের বর্তমান অসম ও নির্যাতন-নিষ্পেষণমূলক অবস্থায় কোনো স্থায়ী পরিবর্তন আসবে না।


এ অবস্থায় কোনো উন্নয়ন উদ্যোগই পুরোপুরি কার্যকর হবে না, বরং তা হবে মূল কারণ টিকিয়ে রেখে পার্শ্ব কারণগুলো দূরীভূত করার জন্য শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ


ক্ষু দ্রায়তনের এই দেশে বিদ্যমান সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা চাপ সৃষ্টি করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যে দেশের একটা উলেল্গখযোগ্যসংখ্যক নারী-পুরুষ প্রতিনিয়ত ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও রোগব্যাধিতে ভোগে, যার বড় অংশই নারী ও শিশু, সে দেশের বিপুল জনসংখ্যা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগ দাবি করে। দেশের সিংহভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর হলেও দ্রুত নগরায়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাড়তি জনগোষ্ঠীর বাসস্থানের চাহিদা ইত্যাদি মেটাতে প্রতি বছরই আবাদি জমি কমে যাচ্ছে, যা ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাকে বিরাট হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই হুমকির সমীকরণ খুব স্বচ্ছ : জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা, আর বিপরীতে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কমছে খাদ্য উৎপাদন। এই বিপরীতমুখী প্রলম্বন আমাদের এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে, এক্ষুণি সতর্ক উদ্যোগ গ্রহণ না করলে আমরা ভয়াবহ রকম এক সংকটজনক পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছি। এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য ছাড়াও অন্য প্রয়োজনীয় চাহিদা যথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট ও যানবাহন এবং জ্বালানির জোগান দেওয়া, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ইত্যাদির জন্য রাষ্ট্রের ওপর যে বাড়তি চাপ পড়ছে, তা মোকাবেলার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি আমাদের নেই।
নবপ্রকাশিত আদমশুমারির পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে নারীর সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ ৬৪ হাজার। এই সংখ্যার গরিষ্ঠভাগ নারীই সনাতনী পরিবার ব্যবস্থা ও প্রজনন কর্মভার, পুরুষতান্ত্রিক সমাজদর্শন ও নানা নির্যাতন-নিষ্পেষণে কাবু। তথ্য-উপাত্ত বলছে, শিক্ষা, প্রশাসন, রাজনীতি ও সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার করে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ উপার্জনকারী কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও স্বীকৃত। আমরা যখন আমাদের নারীদের প্রচলিত-অপ্রচলিত বিভিন্ন নীতিনির্ধারণমূলক ও উপার্জনমূলক কাজে সাফল্যের সঙ্গে বিচরণ করতে দেখছি, তখনও নারীর প্রতি সমাজের সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাদের প্রতি একের পর এক বিভিন্নমুখী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে।
নারীর প্রতি সমাজে বিরাজমান সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে দেখতে চায় একজন ভালো মা, ভালো স্ত্রী, ভালো গৃহিণী হিসেবে। নারী যত শিক্ষিতই হোক, যত উপার্জনকারীই হোক, রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করুক; আমরা তাকে নারী হিসেবেই দেখি। এমনকি সরকার পরিচালনা, মন্ত্রণালয় পরিচালনা, অফিস পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নারী যুক্ত থাকলেও তাকে আমরা সক্রিয় একজন নাগরিক হিসেবে না দেখে নারী হিসেবেই দেখতে চাই। এত কিছুর পরও আমাদের মনোযোগ থেকে এটা দেখায় যে, তিনি কতটা ভালো মা, কতটা ভালো স্ত্রী, কতটা ভালো গৃহিণী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একই জায়গায় থেকে গেছে। সম্প্রতি সংঘটিত রুমানা মঞ্জুরের নির্যাতনের ঘটনা যার একটি হতে পারে। তিনি লেখাপড়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মতো কাজে যুক্ত ছিলেন, উপার্জন করতেন, প্রচলিত সংজ্ঞায় তিনি তার সমাজে ক্ষমতায়িত ছিলেন; কিন্তু তার স্বামী ও পরিবারের সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকেও নির্যাতিত হতে হয়েছে, চোখ হারাতে হয়েছে। নারীর প্রতি সমাজের এই সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কেবল শিক্ষিত হওয়া, উপার্জন করা, অংশগ্রহণ করতে পারাকেই আমরা ক্ষমতায়নের উপাদান হিসেবে দেখছি। ফলে নারী আজ দ্বিগুণ-তিনগুণ কর্মভারে পীড়িত হচ্ছে। উপার্জনমূলক কাজে পুরোমাত্রায় যুক্ত থাকার পরও তাকে পারিবারিক, সামাজিক ও শারীরিক নানা ঝক্কির মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
একটা ছেলের ক্ষেত্রে আমরা বলি, আগে মানুষ হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও, তারপর বিয়ে-সংসার করো ইত্যাদি। একইভাবে একটি মেয়েকেও আগে মানুষ হওয়া ও নিজের পায়ে দাঁড়াবার অবকাশ দিতে হবে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে এ রকম ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ছোটবেলা থেকেই একটা মেয়ে মানুষ হিসেবে সমান স্বীকৃতি ও মর্যাদা পায় এবং শিক্ষা গ্রহণ, পেশা নির্বাচন ও নিজের ভালোমন্দ নিজেই ঠিক করার সুযোগ পায়। একজন মানুষের জীবনে ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সসীমা হচ্ছে সবচেয়ে উৎপাদনক্ষম সময়। অথচ সনাতনী চিন্তাভাবনার কারণে আমাদের সমাজের প্রায় প্রতিটি নারীর এ সময়টা সন্তান জন্মদান ও তার লালন-পালনে ব্যয় হয়ে যায়। এই সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই সমাজ থেকে আইন করেও বাল্যবিয়ে দূর করা যাচ্ছে না, কমানো যাচ্ছে না মাতৃমৃত্যুর উচ্চহারও। আইনানুযায়ী যেখানে একটি মেয়ের বিয়ের নূ্যনতম বয়স ১৮, সেখানে আমাদের দেশে মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স ১৫। ফলে অল্প বয়সেই এই মেয়েদের গর্ভধারণ করে নিজেদের জীবন বিপন্ন করার ঝুঁকি নিতে হয়। নারী সমাজকে সন্তান ও সংসারের ভারে এভাবে জর্জরিত হওয়ার অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে হবে। তাতে মেয়েরা পড়াশোনা করে নিজে উপার্জনক্ষম হতে পারবে, মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমবে, পরিবার ব্যবস্থাপনা করা হবে অনেক সহজ। সন্তানকে ঠিকমতো লেখাপড়া করানো, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া ও মানুষ করে তোলার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্যও তাদের করায়ত্ত হবে। পরিবার ছোট হলে জনব্যবস্থাপনায় সুবিধা হবে রাষ্ট্রেরও। নারীর ব্যাপারে সমাজের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলালে নারী নির্যাতনের হার কমবে। মেয়েকে কোনো পরিবারেই ভার হিসেবে দেখা হবে না। তারা যদি সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার সুযোগ পায়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বাল্যবিয়ের হার কমবে, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমবে, উন্নতি হবে প্রজনন স্বাস্থ্যের। তার অন্যতম প্রধান ফল হবে ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার হার।
কাজেই যত দ্রুত সম্ভব নারীর প্রজনন কর্মভার কমানো ও নারীর প্রতি সমাজের সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সম্ভাব্য উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে, বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মানদণ্ড স্থাপন। তাতে যেসব পরিবার ও সমাজে নারীর প্রতি সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি আছে, রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির আগ্রহে ওই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা বেরিয়ে আসবে। যেমন যদি বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিপ্রাপ্তি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ রকম নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় যে, বাল্যবিয়ে হয়নি বা পরিবারের কারও সন্তানসংখ্যা একটি বা দুটির বেশি নয়, এমন পরিবারের সদস্যদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তাহলে নিশ্চিতভাবে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এই আলোকে চাকরি ও পদোন্নতিপ্রাপ্তি, ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি, স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি, বিনামূল্যে শিক্ষা সুবিধাপ্রাপ্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানদণ্ড স্থাপন করার কথা ভাবা যেতে পারে। তাছাড়া স্কুল-কলেজের পাঠ কার্যক্রম ও প্রচারমাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা, বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে সামগ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগও গ্রহণ করা যেতে পারে।
নারীর প্রতি বিদ্যমান সনাতনী সমাজ ব্যবস্থায় নারী সমাজকে যে পরিমাণ অমানবিক অবস্থার ভেতর দিয়ে জীবনধারণ করতে হয়, সে অবস্থার পরিবর্তন করা না গেলে সমাজের বর্তমান অসম ও নির্যাতন-নিষ্পেষণমূলক অবস্থায় কোনো স্থায়ী পরিবর্তন আসবে না। এ অবস্থায় কোনো উন্নয়ন উদ্যোগই পুরোপুরি কার্যকর হবে না, বরং তা হবে মূল কারণ টিকিয়ে রেখে পার্শ্ব কারণগুলো দূরীভূত করার জন্য শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ।

রোকেয়া কবীর : মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী
 

No comments

Powered by Blogger.