জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের তাণ্ডব by ইফতেখার মাহমুদ ও শামসুজ্জামান

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও রক্তপাত ঘটাল ছাত্রলীগ। গতকাল শনিবার উপাচার্যপন্থী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের কর্মীরা লাঠি, রড ও লোহার পাইপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মীদের বেধড়ক মারধর করেছেন।
এরপর ছাত্রলীগ হামলা করেছে শিক্ষকদের ওপরও।


রাত নয়টায় ছাত্রলীগের শতাধিক কর্মী লাঠি, রড, লোহার পাইপ নিয়ে মিছিল করতে করতে আন্দোলনরত শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপর আবার হামলা চালান। এ সময় তাঁদের ছোড়া ঢিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক শাহনেওয়াজসহ কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিক আহত হন।
ছাত্রলীগের এই তাণ্ডব ও রক্তপাতের ঘটনায় ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে উঠেছে। ছাত্রলীগের এসব কর্মী উপাচার্যপন্থী হিসেবে পরিচিত। তাঁরা গতকাল মিছিল করে উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের প্রতি সমর্থনও জানান।
ছাত্রলীগের এই হামলার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া পুলিশও সরে যায়। এ সময় উপাচার্য ভবনের মূল ফটকের সামনে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনরত শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের ঘেরাও করে ফেলা হয়। ছাত্রলীগের কর্মীরা এ সময় তাঁদের দিকে তেড়ে এসে উপাচার্য ভবনের ফটক থেকে সরে যেতে বলেন এবং গালিগালাজ করতে থাকেন। আন্দোলনকারীরাও মশাল জ্বালিয়ে তখন স্লোগান দিতে শুরু করেন। এরপর শুরু হয় ঢিল ছোড়া ও হামলা। আধা ঘণ্টা ধরে এই অবস্থা চলার পর বিদ্যুৎ চলে এলে ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলা বন্ধ করে কিছু দূরে গিয়ে অবস্থান নেন।
উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল থেকে আমি ঢাকায় অবস্থান করছি, ক্যাম্পাসে ফিরে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মারধরের ঘটনা তদন্ত করে দেখব।’ দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা দায়ী। তাঁরা সিনেট সভা হতে দেননি। ওই সভা হলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হতো।
আন্দোলনরত শিক্ষকেরা গতকাল উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা দাহ করার কর্মসূচি নিয়েছিলেন। ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল করে এসে কুশপুত্তলিকা দাহ করার আগেই ছিনিয়ে নেন। এর আগে বিকেল চারটার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষক সমাজের সংবাদ সম্মেলন যখন চলছিল, ঠিক সে সময়েই খবর আসে, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাংস্কৃতিক কর্মীদের মারধর করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রলীগের আট-দশজন কর্মী সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি কলি মাহমুদকে রড ও লোহার পাইপ দিয়ে পেটাচ্ছেন। এর কিছুটা দূরে ছাত্রলীগের প্রায় ১৫ জন কর্মী লাঠি ও রড দিয়ে সাংস্কৃতিক জোটের সদস্য সুদীপ্ত চক্রবর্তীকে পেটাচ্ছিলেন।
গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে সে সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা মারধর বন্ধ করে মিছিল শুরু করেন। তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘জাহাঙ্গীরনগরের আঙিনায়, জামায়াত-শিবিরের ঠাঁই নাই’; ‘একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’; ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। এই স্লোগান দিতে দিতে ছাত্রলীগের কর্মীরা পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে পরিবহন চত্বরে এসে জড়ো হন। মারধরের নেতৃত্বে থাকা শেখ শরিফুল ইসলাম, এস এম মাহতাব মেহেদি ও সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে মারধর করার অভিযোগ রয়েছে। গত শুক্রবার তাঁদের নেতৃত্বেই আন্দোলনরত শিক্ষকদের ‘উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চ’ ভাঙচুর এবং উপাচার্যবিরোধী ব্যানার, পোস্টার ছিঁড়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া সম্প্রতি একটি মারধরের ঘটনায় জামিন পেয়েছেন মাহতাব মেহেদি ও সাইফুল ইসলাম।
সাংস্কৃতিক কর্মীরা অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর সুকল্যাণ কুমার কুন্ডু পাশেই মাইক্রোবাস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে সময় পাশে দাঁড়ানো সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীরা চিৎকার করে প্রক্টরের সহায়তা চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রক্টর শিক্ষার্থীদের রক্ষা না করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর সুকল্যাণ কুমার কুন্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে, তা ভিত্তিহীন।’
সাংস্কৃতিক কর্মীদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি কলি মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের শেখ শরীফুল, মাহতাব মেহেদি, সাইফুল ইসলামসহ ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র থেকে জোর করে ধরে এনে মারধর করেছেন। কলি মাহমুদ আরও জানান, তাঁর শরীরের হাত, পা ও বুকের পাঁজরে রড দিয়ে পেটানো হয়েছে। তিনি ছাত্রলীগের কর্মীদের বিচারের দাবি করেন।
সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের ওই কর্মীদের নেতৃত্বেই আবার মিছিল শুরু হয়। এ সময় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়া বাস থেকে সাধারণ ছাত্রদের জোর করে নামিয়ে মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। বিভিন্ন হল থেকেও সাধারণ ছাত্রদের জোর করে ধরে আনেন ছাত্রলীগের কর্মীরা।
মিছিল শেষে উপাচার্য ভবনের সামনের মাঠে সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। এ সময় শেখ শরিফুল ইসলাম বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। শিবিরকর্মীদের শব্দ ক্যাম্পাসে শোনা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৩০ বছরে যত উন্নয়ন হয়েছে, গত তিন বছরে তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রা বানচাল হতে দেওয়া যাবে না। মাহতাব মেহেদি দ্রুত ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার দাবি জানিয়ে বলেন, কমিটি দিলে ছাত্রলীগ আরও ভালোমতো শিবিরদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন করতে পারবে।
এর আগে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র থেকে গ্রীষ্মকালীন ছুটি এগিয়ে আনার প্রতিবাদে এবং ক্লাস-পরীক্ষা নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেছিলেন সাংস্কৃতিক জোটের শতাধিক নেতা-কর্মী। মিছিল শেষে তাঁরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমাবেশ করেন।
এ সময় সমাবেশ থেকে উপাচার্যপন্থী চিহ্নিত সন্ত্রাসী অছাত্রদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। তাঁরা শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হলে উপাচার্যের নিজ দায়িত্বে পদত্যাগের দাবি জানান। পরে তাঁরা সন্ধ্যায় একই দাবিতে ক্যাম্পাসে মশাল মিছিলের ঘোষণা দেন। এর চার ঘণ্টা পরই ছাত্রলীগের কর্মীরা সাংস্কৃতিক জোটের সংগঠনের সহসভাপতি মঈন মুনতাসির, সদস্য আশফিক রেদুয়ান, সুদীপ চক্রবর্তী, তারিকুল ইসলাম ও মাসুদকে বেধড়ক মারধর করেন।
গত বুধবার মধ্যরাত থেকেই উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষক সমাজের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষকেরা উপাচার্যের বাসভবনের প্রধান ফটকে তাঁদের অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছেন। ছাত্রলীগের কর্মীদের পুড়িয়ে দেওয়া উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চটি আবার নতুন করে স্থাপন করেছে আন্দোলনরত শিক্ষক সমাজ। তারা নতুন করে ওই মঞ্চের নাম দিয়েছে উপাচার্য বিতাড়ন মঞ্চ।
অপরদিকে বাসভবনের অপর ফটকে ক্যাম্পাসে উপাচার্যের চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য শুক্রবার দুপুর থেকে অবস্থান অব্যাহত রেখেছেন উপাচার্যপন্থী শিক্ষকেরাও।
গতকাল সকালে উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির পুলিশ ও উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশাসনিক ভবনে তাঁর কার্যালয়ে যান। উপাচার্য তাঁর কার্যালয়ে যাওয়ার পর ওই শিক্ষকেরা গত শুক্রবার উপাচার্যপন্থী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পুড়িয়ে দেওয়া উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চের স্থানে এবং প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটকের পাশে অবস্থান নেন। এরপর কাজ শেষে দুপুর একটার দিকে উপাচার্য তাঁর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে গেলে ওই শিক্ষকেরাও তাঁর সঙ্গে চলে যান।
আন্দোলনকারী শিক্ষক সমাজের আন্দোলন পরিচালনা পর্ষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেইন বলেন, ‘উপাচার্যের বিরুদ্ধে কথা বলায় উপাচার্যের পেটোয়া বাহিনী সাংস্কৃতিক কর্মীদের মারধর করেছে। তারা আন্দোলনকারী শিক্ষকদেরও হুমকি দিচ্ছে। তার পরও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে যাব।’

No comments

Powered by Blogger.