চরাচর-হাওরের পানি নাই রে যেথায়, নাই রে তাজা মাছ... by শামস শামীম

হাওরের পানি নাই রে যেথায়, নাই রে তাজা মাছ/বিলের বুকে ডানা মেলা নাই রে হিজল গাছ...' বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তর সিলেটের হাওর জলাভূমির চিরায়ত দৃশ্য ছিল এটি। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও নান্দনিক সৌন্দর্যের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে উপমহাদেশের শেকড়সন্ধানী গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস বৃহত্তর হাওর-বাঁওড়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী এই গণসংগীত রচনা করেছিলেন।


এই গানটির মতোই এখন স্মৃতিকাতর হাওরভাটির মানুষ। হাওরের সুস্বাদু মাছ নিয়ে আফসোস করছেন তাঁরা। একদিকে প্রতিনিয়ত উজানের ঢলের সঙ্গে মেঘালয় থেকে নেমে আসা বালু-পলিতে হাওর ভরাট হচ্ছে। অন্যদিকে প্রকৃতির ওপর আঘাত, বেশি উৎপাদনের জন্য হাইব্রিড মাছ আমদানির কারণে হাওরের মিঠা পানির মাছ ও জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির সম্মুখীন। স্থানীয় বাজারে এখন হাওরের মাছ খুঁজে পাওয়া যায় না। হাওরের সুস্বাদু দেশি প্রজাতির মাছ হটিয়ে বাজার দখলে নিয়েছে স্বাদহীন বড় আকারের হাইব্রিড মাছ। মিঠা পানির হাওরে যে মাছ উৎপাদন হয়, তা-ও চলে যাচ্ছে দেশের বড় শহর আর ভিনদেশে। হাওরের মাছ থেকে এখন অধিকারহারা হাওরবাসী। একটি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, হাওরের প্রায় ১২২ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সুনামগঞ্জ কমিউনিটিভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প 'ফিশারিজ রিসার্চ সাপোর্ট প্রজেক্ট'-এর মাধ্যমে দাতা সংস্থা বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টার এক গবেষণায় জানিয়েছে, একসময় হাওরে ১২২ প্রজাতির মাছ ছিল। দুই বছর আগে সুনামগঞ্জের সাতটি হাওর উপজেলার ৩০টি বিলে গবেষণা চালিয়ে হাওরের দেশি প্রজাতির কিছু মাছকে 'বিপন্ন, মহা বিপন্ন ও সংকটাপন্ন' উল্লেখ করা হয়। দাতা সংস্থা আইইউসিএন সূত্রের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত সুস্বাদু পানির মৎস্য প্রজাতির মধ্যে হাওর-বাঁওড়ে ৫৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব এখন হুমকিতে; প্রায় বিলুপ্ত। প্রতিবেদনে ১২ প্রজাতির মাছকে মহাবিপন্ন, ২৮ প্রজাতির মাছকে বিপন্ন এবং ১৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন হিসেবে উল্লেখ করে। মাছের বিলুপ্ত হওয়া ও সংকটাপন্নের কারণও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিলুপ্তির কারণ হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে দেশি মাছ নিধন করে বিদেশি মাছ চাষ, হাওরের বোরো ফসলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এবং ভারতের মেঘালয়ে কলকারখানার বর্জ্যদূষণসহ বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। একইভাবে পরামর্শ হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে দেশি প্রজাতির মাছ চাষে লোকজনকে উদ্বুদ্ধকরণ, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিপন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন, বিদেশি মাছ আমদানির আগে দেশীয় মৎস্য প্রজাতি ও জলজ পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রভাব সম্পর্কিত সমীক্ষাপূর্বক মাছ চাষের কথা বলা হয়। ফিশারিজ রিসার্চ সাপোর্ট প্রজেক্ট ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন হাওর-বাঁওড় ও বিলে গবেষণা চালায়।
মূলত দেশীয় প্রযুক্তি ও ঐতিহ্যগত ব্যবস্থাপনার বিন্যাসের কথাই বলা হয়। মাছের অভয়াশ্রম স্থাপন ও এর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, মাছের আবাসস্থল পুনরুদ্ধার ও বিল পুনঃসংস্কার, জলজ বনায়ন সৃজন ও মৎস্যজীবীদের সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়নের কথাও রয়েছে প্রতিবেদনে। ৩০টি বিলের গবেষণা এলাকা দুইটিতে ২৫ থেকে ৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যাওয়ায় ওই বিল Bio-diversity ঝুঁকিতে বলে উল্লেখ করা হয়।
শামস শামীম

No comments

Powered by Blogger.