জাগ্রত চৌরঙ্গী by মোক্তাদির রশিদ আদর

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন কর্মস্থলে ছুটে আসতে হয়। সময় যায় যায়। যানজটের খপ্পরে পড়ে কত সময় যে ঝরে যায়, সে হিসাব নাইবা করলাম। পথের ধারে অবস্থিত ডাস্টবিনের বিকট দুর্গন্ধ। দেয়ালে সাঁটা রঙ-বেরঙের পোস্টার, ছোটবড় বিলবোর্ড। বিজ্ঞাপন।


সাইনবোর্ড আকারের পলিসাইনের বিজ্ঞাপনগুলোর আধিপত্য বেশিই নজরে পড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তিপরিচয় এমনকি দলীয় বিজ্ঞাপনের আধিপত্য দিনের পর দিন বাড়ছে। সড়কের পাশে একটু ফাঁকা জায়গা পেলেই হলো।
'৫২, '৭১-কে ঘিরে তৈরি ভাস্কর্যগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। দেশের আনাচে-কানাচে এমন অনেক ভাস্কর্য আছে, যা দেখে আমরা একটিবারের জন্য হলেও ফিরে যাই ফেলে আসা অতীতে। আমরা বিজয় দেখিনি। দেখিনি মাতৃভূমিকে রক্ষার শপথে জীবনবাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধরত কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে। শুনেছি। পড়েছি। দেখছি মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁজি করে নোংরা রাজনীতির খেলা। এ খেলা শুধু জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হেয় করছে তা নয়, আগামী প্রজন্মের সঙ্গেও প্রতারণা করছে। ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতাকে কলুষিত করছে। আমরা যেমন চাই সুন্দর একটা বাংলাদেশ, তেমনি চাই প্রতিটি শহীদ, যুদ্ধাহত ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাকে যথাযথ সম্মান জানাতে। চাই একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার। এক কথায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। ক্ষমতা দখলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থরক্ষায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা শব্দ দুটি অবলীলায় ব্যবহার করছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির জন্য দায়ী করছে। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে তৈরি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। যুক্ত হচ্ছে, বাদ পড়ছে।
আমরা এসব আর দেখতে চাই না। চাই সত্যটা জানতে। চাই সম্মান জানাতে। চাই তাদের জন্য জমে রাখা ভালোবাসা প্রকাশ করতে। হানাহানি নয়, রক্তপাত নয়, হরতাল নয়_ মনেপ্রাণে আমরা চাই_ ত্রিশ লাখ শহীদের স্বপ্ন পূরণে সব দল, সব মানুষ এক সঙ্গে কাজ করুক।
'জাগ্রত চৌরঙ্গী' গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। ঘেরা বৃত্তের মাঝে সময়ের সাক্ষী হয়ে প্রতিমুহূর্তে জানান দেয় ফেলে আসা সময়ের কথা। নীরব সে কথাগুলো আমরা উপলব্ধি করি হৃদয় দিয়ে, দেশপ্রেম দিয়ে, শ্রদ্ধাভরে। জাগ্রত চৌরঙ্গীর সামনে এসে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। পারি না। কখনোই সম্ভব হয়নি। প্রেরণা নিতে এসে আহত হতে হয়। কান্না এসে যায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এখনও এ দেশে লাখো মুক্তিযোদ্ধা জীবিত। তাদের আমরা কতটুকু সম্মান করি? এ দেশটাকে কতটুকু ভালোবাসি? জাগ্রত চৌরঙ্গীর সামনে এলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের দায়িত্ববোধ, বিবেক বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ঘেরা বৃত্তের চারপাশ বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, ব্যক্তিপরিচয়_ সব ধরনের বিজ্ঞাপন ঠাঁই পেয়েছে। বিবেকবান মানুষের বিবেকহীন কাজ আমাদের ব্যথিত করে। ভাবিয়ে তোলে। আহত করে। পবিত্রতা রক্ষায় আমরা ব্যর্থ। প্রশাসনের নীরব ভূমিকা বিবেকহীনদের আরও উৎসাহিত করে। গর্বিত ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দেশের প্রতিটি স্থানে গড়ে ওঠা ভাস্কর্যগুলোর পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষার্থে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইনের মাধ্যমে বিচারের সম্মুখীন করার বিধান রাখতে হবে; যাতে করে দেশের সচেতন মহল বা ব্যক্তি দোষীদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারে।
 

No comments

Powered by Blogger.