বিশ্বনাথে হরতাল আতঙ্ক by মোহাম্মদ আলী শিপন

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আজ রবিবার ও পরের দিন সোমবার আবারও হরতাল ডাকায় আতঙ্কে আছে সিলেটের বিশ্বনাথের মানুষ। দলটির নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় গত ২৩ এপ্রিল হরতাল চলাকালে বিশ্বনাথে সহিংসতায় তিনজনের প্রাণহানি এখনো ভুলতে পারছে না মানুষ।


এ ছাড়া ওই ঘটনায় দুটি মামলায় প্রায় আট হাজার লোককে আসামি করায় এখনো স্বাভাবিক হয়নি এলাকার পরিস্থিতি। এ অবস্থায় আবার দুই দিনের হরতাল নিয়ে শঙ্কিত সবাই। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথ। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর কয়েক দিন ধরেই উপজেলায় এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে উপজেলা সদরে হরতালে গোলাগুলির ঘটনায় তিনজনের মৃত্যুতে এলাকায় চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। যে কারণে লোকজন বাসাবাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। আর এর প্রভাব পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষের ওপর।
গতকাল শনিবার উপজেলা সদরের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা জানান, পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁরা রয়েছেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে।
আবারও হরতাল ডেকেছে বিএনপি। আবারও কি সেই দিনের মতো সহিংসতার দিকে এগোচ্ছে বিশ্বনাথ_এমন অজানা শঙ্কা তাড়া করছে উপজেলাবাসীকে। তারা আর কোনো অবস্থাতেই সহিংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না।
তবে ইলিয়াস আলীকে ফিরে পেতে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের পক্ষে মত দিয়েছে অনেকেই। দল-মতনির্বিশেষে সবার প্রত্যাশা, ইলিয়াস আলী সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন।
বিশ্বনাথের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী কবির আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হরতাল মানে আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের পেটে লাথি মারা। তবে ইলিয়াস আলীর জন্য হরতালে আপত্তি নেই।'
একজন অটোরিকশাচালক বলেন, ওই দিনের গোলযোগের পর দুই দিন হলো গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছেন। কিন্তু আগের মতো রুজি-রোজগার হচ্ছে না।
ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া বলেন, 'প্রতিদিন ভয়ের মধ্য দোকান খুলি। দোকানে মাল থাকলেও ক্রেতা নেই। মানুষজন বাজারে আসে খুবই কম। আগের মতো বেচাকেনা হয় না। হরতালে তো দোকান বন্ধ থাকবে।'
রিকশাচালক রফিক আলী বলেন, এক যুগ ধরে তিনি রিকশা চালান। বিশ্বনাথে অনেক হরতাল দেখেছেন। কিন্তু কোনো হরতালই তাঁকে ঘরে বসে থাকতে হয়নি। ইলিয়াস আলীর জন্য হরতাল হওয়ায় ঘরে বসে থাকতে হয়।
সবজি বিক্রতা আমির আলী বলেন, ওই ঘটনার পর থেকে তেমন বেচাকেনা নেই। অনেক মাল নষ্ট হওয়ার পথে রয়েছে। এভাবে চললে প্রায় ৩০ হাজার টাকার ক্ষতি হবে তাঁর।
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গৌছ খান বলেন, 'ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়ার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কেউ যদি বাধার সৃষ্টি করে তাহলে প্রতিরোধ করা হবে।'
বিশ্বনাথ থানার পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'যেকোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা রক্ষায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
নির্বাক আনসারের মা মুখে কোনো শব্দ নেই তাঁর। শুধু ঘরের বারান্দায় বসে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকেন। বাড়িতে নতুন কোনো মানুষ এলেই আগের মতো আর তাঁকে বিচলিত হতে দেখা যায় না। পরিচিতদের হাত জাপটে ধরে হাউমাউ করে বলতে শোনা যায় না_'আমার ছেলে কোথায় আছে? কেমন আছে? আমার বুকের মানিককে আমার কাছে এনে দাও।' শারীরিক অবস্থারও অবনতি হচ্ছে ক্রমাগত। ছেলের অপেক্ষায় এভাবেই পথপানে চেয়ে থাকেন ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক নিখোঁজ আনসার আলীর মা নুরজাহান বেগম।
গতকাল বিকেলে নিখোঁজ আনসারের জন্মস্থান সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার গুমরাকুল গ্রামের বাড়ি গেলে চোখে পড়ে এমন চিত্র।
নিখোঁজ হওয়ার ১২ দিনেও রহস্যের কূলকিনার না হওয়ায় একেবারেই ভেঙে পড়েছেন আনসারের মা নুরজাহান বেগম।
আনসারের ভগি্নপতি লিয়াকত আলী বলেন, নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শুনেই নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ছেলেকে ফিরে পেতে মা কান্নায় বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। লোকজন দেখলেই 'আমার আনসার কোথায় আছে? কেমন আছে? তাকে আমার বুকে এনে দাও' বলে আহাজারি করতেন। গত তিন দিন থেকে তাঁর মুখে কোনো কথা নেই। নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকেন পথের দিকে।

No comments

Powered by Blogger.