বুয়েট ও জাবির অচলাবস্থার অবসান চাই by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালোই চলে আসছিল। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেশনজটের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসতে অনেকটা সক্ষম হয়। শুরুতে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় হোঁচট খেলেও ক্রমেই তা কাটিয়ে উঠতে থাকে।


মাসের পর মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার রেওয়াজ অনেকটা কমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ভাইস চ্যান্সেলরদের ভয়াবহ ইমেজ সংকটে ভুগতে দেখা যায়নি। মোটা দাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালোভাবে চলা বর্তমান সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের একটি বড় নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
কিন্তু বর্তমানে বড় দুটি বিশ্ববিদ্যালয় অচল হওয়া সরকার থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সবাইকে পীড়া দেয়। এখানে নেই ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব। একমাত্র শিক্ষকদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও স্বার্থের জন্য দুটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাজীবন আজ দারুণ সংকটে। এ সংকটের জন্য দায়ী আমাদের ছাত্র সমাজ নয়, ছাত্রদের জীবন গড়ার কারিগর আমরা শিক্ষকরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা নিশ্চুপ। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজও নির্বিকার। ছাত্র সংগঠনের কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব কিংবা সংঘাতের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অচল হলে অনেককেই ছাত্রদের দায়ী করে কলম ধরতে দেখা যায়। পত্রিকায় কলাম লেখার হিড়িক পড়ে। কিন্তু এখনকার চিত্র ভিন্ন। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় একমাত্র অনুরোধ করা ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের কারো কিছু করার থাকে না। তাই তো শিক্ষামন্ত্রী অসহায়ভাবে বুয়েটের শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফিরে যেতে। তিনি তাঁর অসহায়ত্বের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। বলেছেন, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার সূত্রপাত জুবায়ের হত্যাকাণ্ড দিয়ে। আমরা অনেকে জানি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ফৌজদারি ক্ষমতা ভোগ করে না। কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়মতান্ত্রিক পথে সেই কাজটি করেছে। আশা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
কিন্তু জুবায়ের হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে আরো কিছু অভিযোগ সামনে এনে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগগুলোর মধ্যে দুটি বড় অভিযোগ হলো, সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ না দেওয়া এবং উপাচার্যের দুর্নীতি, দলীয় নিয়োগ ও স্বজনপ্রীতি। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চারটি ছাড়া বাকিগুলোতে চ্যান্সেলর মহোদয় সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ দেন। যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হয়, সেগুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর একটি। শিক্ষকদের দাবিটিকে আমি সম্পূর্ণ যৌক্তিক মনে করছি, কিন্তু এ দাবি পূরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়ার এখতিয়ার কি শিক্ষকদের আছে? একই পন্থায় বাকি তিনটি (ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম) বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার কথা। সেখানকার শিক্ষকরা এ দাবির ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু এ দাবির জন্য তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দিচ্ছেন না। সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ কিংবা চ্যান্সেলরের মাধ্যমে সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ_যে পন্থায়ই হোক না কেন, ভালো উপাচার্যই আমাদের প্রয়োজন। যদি উপাচার্য ভালো না হন, সে ক্ষেত্রে শিক্ষকরা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করতে পারেন। ধর্মঘটের নামে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পর্যায়ে পড়ে না।
দ্বিতীয় অভিযোগ হলো, উপাচার্য দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ হরহামেশাই হয়ে থাকে। মৌলিক বা কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া আমরা এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব কি না সন্দেহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া অন্যান্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার চেয়ে একটু ভিন্ন। এখানে একমাত্র বাছাই বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। নেই লিখিত পরীক্ষার শর্ত। খুব ভালো রেজাল্ট নিয়েও বাছাই বোর্ডের সামনে ভালো সফলতা না দেখাতে পারলে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। অস্বীকার করছি না, এখানে দলীয় বিবেচনার আশ্রয় নেওয়া হয় না, কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিবর্তন না করলে এ ধরনের অভিযোগ থেকেই যাবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে নেট (ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট) দিতে হয়। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল শিক্ষক হওয়ার নূ্যনতম যোগ্যতা একজন প্রার্থী অর্জন করেন। বর্তমানে আমাদের দেশে বেসরকারি স্কুল-কলেজে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও আমরা এ পন্থা অবলম্বন করতে পারি। এতে উন্নত মান এবং দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে কমানো সম্ভব হতে পারে। এ প্রয়োজনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে আসতে পারে। এ জন্য আরো প্রয়োজন মৌলিক পরিবর্তন। প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়া কি আমাদের কাম্য? বুয়েটের প্রেক্ষাপট জাহাঙ্গীরনগরের প্রেক্ষাপট থেকে একটু ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার নিয়োগকে কেন্দ্র করে এ ঘটনার সূত্রপাত। এখানে রেজিস্ট্রারকে ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে আন্দোলন চলছে। এর অংশ হিসেবে শিক্ষক সমিতি উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছে। তাদের দাবি, উপাচার্য দলীয় বিবেচনায় কম মেধাবীদের নিয়োগ দিচ্ছেন এবং উপ-উপাচার্য অপেক্ষাকৃত জুনিয়র। আমার জানা মতে, বুয়েটের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেন চ্যান্সেলর। একজন জুনিয়রকে উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না_এমন বিধান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে সম্ভবত নেই। থাকলে নিয়োগকে আমি অবৈধ বলব। জুনিয়র শিক্ষক যদি দক্ষ-অভিজ্ঞ (প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা) হন, তাহলে ক্ষতি কিসের? আমি এর মধ্যে অন্য কিছু দেখছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কখনো কখনো জুনিয়র কেউ সিনিয়রকে টপকিয়ে ওপরের পদে আসীন হন। তখন কি আমাদের খারাপ লাগে না? তাহলে উপ-উপাচার্য পদে জুনিয়র হলে সমস্যা কোথায়? এ ক্ষেত্রেও আমি বলব, মৌলিক কিংবা কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আমার কাছে মনে হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ফসল, যা আমাদের কাম্য নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো তার ছাত্রছাত্রী। সেই ছাত্রছাত্রী যদি ক্যাম্পাসে না থাকে, নিয়মিত ক্লাস না হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে লাভ কী? বিশ্ববিদ্যালয় একটি ভুতুড়ে নগরে পরিণত হয়। আমি শিক্ষকদের দাবিগুলোকে যৌক্তিক মনে করছি, কিন্তু এর জন্য আন্দোলন হওয়া উচিত নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায়। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে আন্দোলন আমাদের কারো কাম্য নয়। আশা করি, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ বিষয়টি বুঝবেন এবং অচিরেই ক্লাসরুমে ফিরে যাবেন।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.