এই দিনে-মনে পড়ে আসাদের কথা? by শারমিন নাহার

জানুয়ারি মাসের শীতের দুপুরটা বেশ ঝরঝরে। আকাশ স্বচ্ছ আর মেঘমুক্ত। নিত্যদিনের মতো ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি চলছে। তবে এই গেটের কাছে এলেই গাড়ির গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে যায়। বাসস্টপেজ বলে যাত্রীরা নামে, নতুন যাত্রী ওঠে। যাত্রী ওঠা-নামা চলে দিনমান আর গেটের নামটাও সবার জানা। তবে কেন এই গেটের নাম হলো ‘আসাদ গেট’, তা কি কেউ বলতে পারে?


এরই মধ্যে একটা গাড়ি থামে, যাত্রীরা নামতে থাকে। এদের মধ্যে ছিলেন আহম্মেদ রফিক। ব্যাংকার। জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, কেন এই গেটের নাম হলো আসাদ গেট?
রফিক সাহেব প্রশ্ন শুনে একটু অবাক। একটা উত্তরও দিলেন। ‘গেটের নাম তো শুরু থেকেই আসাদ গেট। আর আসাদ তো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।’
কথা না বাড়িয়ে চলে যাই অন্য যাত্রীর কাছে। পাশেই মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মুন। একই প্রশ্ন তার কাছে। বেণি দুলিয়ে সে উত্তর দেয়, ‘কেন, আসাদ তো দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। আর এই গেটের সামনে শহীদ হওয়ার কারণে গেটের নাম আসাদ গেট।’
কলেজপড়ুয়া একদল তরুণ যাচ্ছিল এই পথ ধরে। জানতে চাই, বলুন তো, যাঁর নামে এই গেট, সেই আসাদ কে? সবাই এ-ওর দিকে তাকায়। ওদের দৃষ্টি বলে দেয়, এই গেটের নাম ওরা জানে না। তবু একজন চেষ্টা করে উত্তর খোঁজার। বলে, ‘আসাদ তো ভাষাশহীদ। এই ভাষাশহীদের নামেই তৈরি হয়েছে গেট।’
আচ্ছা, কোথায় শহীদ হয়েছিলেন আসাদ?
একটি ফাস্টফুডের দোকানের কর্মচারী রাকিব বললেন, ‘কেন, এখানেই! এখানে শহীদ হয়েছিলেন বলেই তো এই গেটের নাম আসাদ গেট।’
আজ শহীদ আসাদ দিবস। আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেকে জানে না আসাদের পরিচয়। অনেকেই জানে না, কী অসাধারণ একটি সময় পার করেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার আগে ১৯৬৯ সালটি ছিল মিছিলে মিছিলে উদ্ভাসিত। শহীদ আসাদ দিবস আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু ঊনসত্তরের সেই উত্তাল সময়টিতে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ নিজের জীবন দিয়ে যে মানুষটি গণ-আন্দোলনে আনলেন নতুন মাত্রা, তাঁকে ভুলে গেলে কি চলে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক (সুপার নিউম্যারারি) সাখাওয়াত আলী খানের শরণাপন্ন হই। জানতে চাই আসাদের বিষয়ে। ‘আসাদ তো আমাদের শোণিত ধারায় বহমান।’—ঠিক এই কথা দিয়ে আসাদের বিষয়ে বলতে থাকেন তিনি। ‘আসাদ সম্পর্কে এক বাক্যে বলা যায়, আসাদ ছিলেন “ধ্রুপদী রাজনৈতিক কর্মী”। দেশের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁকে আমাদের মাঝে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। আসাদের মৃত্যুর আগে ভাষা আন্দোলন, ছয় ও এগারো দফা আন্দোলন হয়েছে। শহীদ হয়েছেন অনেকেই। তবে পুলিশের গুলিতে আসাদের মৃত্যুর খবর যেন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আসাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। রাজনীতিতে আসাদের ছিল তখন সক্রিয় অবস্থান। ২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যুতে ঊনসত্তরের আন্দোলন যেন চাঙা হয়ে যায়। বাঙালির কণ্ঠে তখন “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা” কিংবা “জাগো বাঙালি জাগো” স্লোগান। তখন সব বাঙালি যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে। মূলত আন্দোলন শুরু হয়েছিল আরও আগে থেকে। তবে ঊনসত্তরে আন্দোলন যেন নতুন মাত্রা পায়।’
কথাগুলো বলার সময় এই প্রবীণ শিক্ষকের চোখ চকচক করে ওঠে। তিনি যেন ফিরে গেছেন সেই আন্দোলনের সময়টিতে। কিছুটা থেমে আবার তিনি বলতে শুরু করেন, ‘না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না, কী পরিস্থিতি হয়েছিল তখন দেশে। আসাদের মৃত্যু বাঙালির মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে তারা সেই সময়ই আইয়ুব এভিনিউতে ছুটে যায়। ক্ষুব্ধ বাঙালি আইয়ুব গেটের তাৎক্ষণিক নামকরণ করে আসাদ গেট আর এভিনিউটির নাম দেয় আসাদ এভিনিউ। আজ অবধি সেই নামই রয়েছে। আর আন্দোলন থামেনি। এই আন্দোলনের ফল হিসেবে ধাপে ধাপে এসেছে স্বাধীনতা। বলা যেতে পারে, ধীরগতিতে চলা আন্দোলন হঠাৎ যেন প্রাণ ফিরে পায় আসাদের মৃত্যুর মাধ্যমে।’
১৯৬৯ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে বের হওয়া উত্তাল মিছিলটিতে ছিলেন আসাদ। দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে মিছিলটি চানখাঁর পুলের কাছাকাছি আসতেই পুলিশের সামনে পড়ে। আন্দোলনকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেই মিছিলে গুলি ছোড়ে পুলিশ। শহীদ হন আসাদ। আসাদের শার্ট নিয়ে মিছিলটি প্রদক্ষিণ করতে থাকে ঢাকা শহর।
আজকের এই দিনে শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা বারবার মনে পড়ে যায়—
‘মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম,
আমাদের হূদয়ের রৌদ্র ঝলসিত
প্রতিধ্বনিময় মাঠে।
চৈতন্যের প্রতিটি মোচায়।...
আসাদের শার্ট আজ আমাদের
প্রাণের পতাকা।’
আসাদের শার্ট কেবল শার্ট হয়েই নয়, বরং পতাকা হয়ে প্রতিটি বাঙালির হূদয়ে জ্বলজ্বল করুক। বাঙালি আসাদ কে জানুক, জানুক প্রকৃত ইতিহাস।

No comments

Powered by Blogger.