স্মরণ-স্মৃতিতর্পণ: আমার মা by খসরু চৌধুরী

পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছেন, যাঁরা আইনত ধর্মত মানবিক আবেদনকে সাক্ষী রেখে মাকে অসম্মান করতে পারেন। ফলে মাতৃ-উবাচ রচনা করে আমি পাঠকদের পৌনঃপুনিকতার চিরায়ত পুরাণ শোনাব না। আমি এমন একজন সংগ্রামী মানুষের কথা শোনাব, যিনি একাধারে শিক্ষাব্রতী, নারী অধিকারের প্রবক্তা এবং অদম্য অনমনীয় মানুষ—ঘটনাচক্রে তিনি আমি ও আমার ভাইবোনের মাতা।


আমার নানা মোবারক আলী চৌধুরী পুলিশ অফিসার হিসেবে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন থানায় কর্মরত ছিলেন। সন্তানসহ প্রথম দুই স্ত্রী গত হলে মকিমপুরের সৈয়দবাড়িতে তিনি তৃতীয় বিয়ে করেন। এই স্ত্রীর প্রথম সন্তান আমার মা।
নানা মহাশয় চাকরিতে অবসর নিয়ে তাঁর প্রথম পক্ষের শ্বশুরবাড়ি হরিরামপুর থানার হরিণা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। ব্রিটিশ-ভারতে সে সময় সম্ভ্রান্ত মুসলমান বাড়িতে মেয়েদের জন্য মৌলভি রেখে সামান্য আরবি শেখার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু নানা মহাশয় ও তাঁর প্রথম পুত্র সামসুল হুদা চৌধুরী (বড় মামা) সাহেবের উৎসাহে তিনি পাটগ্রাম হাইস্কুলে ভর্তি হন। স্মৃতিচারণায় মা আমাকে জানিয়েছিলেন, স্কুলে তিনিসহ মাত্র দুজন মুসলমান ছাত্রী ছিলেন। নানা মহাশয় তাঁকে ছেলেদের মতো চুল ছাঁটিয়ে মাথায় টুপি পরিয়ে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন।
বড় মামা অত্যন্ত শৌখিন মেজাজে মানুষ ছিলেন। নানার মৃত্যুর পর স্থানীয় নিয়োগী জমিদারদের সঙ্গে মামলায় জড়িয়ে এবং পদ্মার ভাঙনে জমিজমা শেষ হয়ে গেলে মামা নিজেকে গুটিয়ে নেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৪ বছর বয়সে মায়ের বিয়ে হয়ে যায় জয়পাড়ার চৌধুরী পরিবারে। আমার বাবা আব্দুল মান্নান চৌধুরীও ছিলেন পুলিশ অফিসার। বিয়ের পর বাবার চাকরিস্থল তৎকালীন পটুয়াখালীতে চলে আসেন মা। সেখানেই আমার জন্ম। নবজাতককে কী করে খাওয়াতে হয়, সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ মা সেটা জানতেন না। প্রায় তিন দিন শুধু জল খেয়ে থেকে নানি এসে উপযুক্ত খাবার খাওয়ালে বেঁচে যাই। আমার চার বছর বয়সে মা প্রবেশিকা পাস করেন। আমি খুব উত্ত্যক্ত করতাম বলে সিরাজ নামের একটি কাজের লোককে ভার দেয় আমার দেখাশোনার। সে খুব ভালো ছবি আঁকত, আমার হাতেখড়ি তারই হাতে।
বড় মামার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়লে আমার নানি তাঁর দুই কন্যা ও এক পুত্রসহ আমাদের বাড়িতে ওঠেন। বাবার ওপর এই বোঝাটি মাকে হয়তো বিব্রত করত! তিনি পটুয়াখালী কলেজে ভর্তি হলেন। পরিবারের অর্থনীতির দুরবস্থায় তাঁকে এক কাপড়েই কলেজে যেতে হতো। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল এক কাপড় পরা মহিলা। এরপর মির্জাগঞ্জ, হিজলা প্রভৃতি এলাকায় বদলি হলে মায়ের পড়াশোনার পাট আপাতত শেষ হয়।
১৯৬১ সালে বাবা হঠাৎ চাকরিস্থল ছেড়ে পৈতৃক ভিটা জয়পাড়ায় চলে আসেন। এর মধ্যে আমার দুটো বোন হয়েছে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ছিলেন মায়ের সম্পর্কিত খালু। তাঁর সহায়তায় মা জয়পাড়ায় মেয়েদের কো-অপারেটিভ গড়ে তোলেন। আমার দাদাবাড়ির তৎকালীন অবস্থা ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ির—সংগতি নেই, চালিয়াতি আছে। এই পরিবারের সবাই প্রায় কলকাতায় থাকতেন, বাবুগিরি করতেন। টাকা-পয়সার দরকারে বাড়ি আসতেন। শিক্ষার অভাবে আত্মীয়দের খুব একটা সদ্ভাব ছিল না। মায়ের করা কো-অপারেটিভকে ভালো চোখে দেখা হয়নি। তার ওপর মেয়েদের আর্থিক সংগতি বিষবৎ মনে করা হতো। পরিণতিতে আমার বাবা আবার কর্মস্থলে যোগ দিলে প্রতি রাতে আমাদের বাড়িতে চুরি হওয়া শুরু হলো।
মায়ের আপন খালা ও খালু ছিলেন মওলানা ভাসানীর কাছের মানুষ। আসামের লাইন ভাঙা আন্দোলনের সহযোদ্ধা। আমার সেই নানি খুবই দাপুটে মানুষ। তাঁর একমাত্র পুত্র গোলামুর রহমান দৈনিক বাংলার সম্পাদক হয়েছিলেন। তিনি মায়ের সমবয়সী—সব সময় সাহস জোগাতেন। ওই নানি এবং মায়ের আত্মীয় সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়ার সহযোগিতায় মা আপওয়ার (অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন) একজন অ্যাকটিভিস্ট হয়ে পড়েন। এদের একটি নারী পুনর্বাসন সংস্থা বায়তুল আমানের সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে যোগ দেন। হূষিকেশ দাশ রোডের একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়িতে অর্ধশিক্ষিত স্বামীহারা মিলিটারি অফিসারের স্ত্রী থেকে শুরু করে নানা স্তরের মেয়েদের হাতের কাজ, কিছু বিদ্যা-শিক্ষা দেওয়া হতো এখানে। কয়েক বছর পর প্রতিষ্ঠানটি বুড়িগঙ্গার ওপার শুভাঢ্যায় চলে গেলে মা চাকরি ছেড়ে ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাকশন ট্রেনিং নেন। ইতিমধ্যে বাবার প্রমোশন হলে অবস্থার উন্নতিতে আমরা বাবার সঙ্গে যোগ দিই। ১৯৬৭ সালে ফরিদপুর শহরে বাবার বদলি হলে মা স্থানীয় আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে আমার সঙ্গে মা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। বিএতে পরে ভর্তিও হয়েছিলেন, চালিয়ে যেতে পারেননি।
মায়ের সঙ্গে আমার একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল ’৭১ সালে। আমার হালকা অস্ত্রের ট্রেনিং ছিল ইউওটিসির মাধ্যমে! আমরা আড়াই হাজার ছেলে-বুড়োকে ট্রেনিং দিয়েছিলাম। এর মধ্যে বন্ধুরা ভারতে যেতে থাকলে আমিও তাদের অনুগামী হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। মা অত্যন্ত শক্ত ধাঁচের মানুষ, কিন্তু এই দেখলাম ভেঙে পড়েছেন! আমি যদিও ওপরে ছাত্রলীগের পাতিনেতা ছিলাম, কিন্তু আদতে ছিলাম পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত। আমার ভারতে যাওয়া নিয়ে বন্ধু মুজিবুল হাসান কিছলু, মজিদ শিকদার, বোরহানউদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। তাঁরা জানালেন তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ফ্যাসিজমে রূপ নেয়। বর্তমানের যুদ্ধে পাতিবুর্জোয়ারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে পাতিবুর্জোয়ারা সরে পড়বে আর শ্রেণীযুদ্ধ শুরু হবে। তখন পাতিবুর্জোয়ারা আমাদের খতম করবে। তবে এখন জাতীয় যুদ্ধে যোগ দেওয়া কর্তব্য আর সেটা ভারতে না গিয়ে শহর গেরিলা হিসেবেই কাজ করলে অনেক কাজ হবে। মায়ের দুর্বলতা, পার্টির যুক্তিতে শহর গেরিলাই হয়ে গেলাম।
১৯৮০ সালের দিকে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও মা ফরিদপুর মহিলা ক্রীড়া সংস্থা চালু করেন ও সম্পাদক নিযুক্ত হন। বাবা অবসর নিলে মা-ই সংসারের সব ভার নেন। আমি যখন আর্কিটেকচার ছেড়ে নাটক-চলচ্চিত্র-আবৃত্তি-রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি, তাতে আমার বাবা খুব হতাশ হয়েছিলেন। হতাশাটা মায়েরও হয়তো ছিল, কিন্তু মুখে কোনো দিন কিছু বলেননি।
এমনই ছিলেন আমাদের মা বেগম চৌধুরী নুরুন্নাহার। আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

No comments

Powered by Blogger.