বিশেষ সাক্ষাৎকার-বেআইনি কাজের জন্য বিএসএফের শাস্তি হওয়া উচিত by নারায়ণচন্দ্র শীল

পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি নারায়ণচন্দ্র শীলের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন নোয়াখালী জেলায়। ২০০৫ সালের ৫ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি।


১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিসে (বিচার বিভাগ) শিক্ষানবিশ মুনসেফ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে চব্বিশ পরগনা জেলার দক্ষিণ আলিপুরে অতিরিক্ত এবং সেশন জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একপর্যায়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আইন বিভাগের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ২০০১ সালের ১৮ মে কলকাতার হাইকোর্টের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

প্রথম আলো  আপনি তো সাত বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ আপনার পৈতৃক বাড়ি, এখন প্রতিবেশী দেশ। দুই বাংলার মানবাধিকার পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
নারায়ণচন্দ্র শীল  আমার নিজের গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালীতে। এখন যেটা লক্ষ্মীপুর হিসেবে পরিচিত। তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার ধারণা কম। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি আমার জানা আছে। তবে বাংলাদেশে এসে একটা বিষয় আমাকে আপ্লুত করেছে, তা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি এখানে যেভাবে দানা বাঁধছে, তা খুবই আশাব্যঞ্জক। এমন একটা ধারণা আছে যে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি শুধু কাগজে-কলমে রয়েছে। বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশে এবার এসে আমি দেখলাম, এটা ঠিক নয়।
দেশ বিভাগের সময় হিন্দুরা যে সম্পত্তিগুলো ফেলে রেখে পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিল, তা নিয়ে এ দেশে অনেক ধরনের আলোচনা হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রী মশায় বিষয়টি নিয়ে তৎপর, সিভিল সোসাইটি বেশ সোচ্চার। এই সম্পত্তিগুলোর একটা বিহিত করার চেষ্টা চলছে। একটি কমিশন করে সরকার ওই সব সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দিতে চাইছে। এটা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারের দিক থেকে খুবই ইতিবাচক দিক।
প্রথম আলো  পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন বলে মনে করেন?
নারায়ণচন্দ্র শীল  পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চাকে আমি বেশ ভালোই বলব। গুজরাটের গোধরায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় একজন মুসলমান সংখ্যালঘু পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিরাপদে ভালোই ছিলেন। এ ধরনের অনেক ঘটনার কথা বলা যাবে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা বেশ ভালোই আছে বলে আমার মনে হয়।
প্রথম আলো  কিন্তু বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও কি মুসলমানদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি হস্তান্তর নিয়ে রাজ্য সরকারের কোনো উদ্যোগ আছে?
নারায়ণচন্দ্র শীল  না, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে এটা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপার। রাজ্য সরকার বা মানবাধিকার কমিশন এগুলো নিয়ে কাজ করে না।
প্রথম আলো  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের কোনো ঘটনা কি ঘটে?
নারায়ণচন্দ্র শীল  একদম যে ঘটে না, তা নয়। যেমন, মাওবাদীদের দিক থেকে এ ধরনের অনেক অভিযোগ প্রায়ই আসে। এ ধরনের পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের কমিশনে এসেছে। জঙ্গলমহাল এলাকায় মাওবাদীদের ওপর নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা এগুলো তদন্ত করে দেখছি। যেমন, কিষান নামের একজন মাওবাদী নেতাকে হত্যার ঘটনাটি আমরা গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখছি। তবে ঝাড়খন্ড, বিহার ও উত্তর প্রদেশে মাওবাদীরা বেশি তৎপর।
প্রথম আলো  সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশিদের নিয়মিতভাবে গুলি করে মারছে। সম্প্রতি বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানীকে মেরে বিএসএফ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিল। সীমান্তে নিয়মিত বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিরা মারা যাচ্ছেন, যার বেশির ভাগ ঘটনাই পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে ঘটছে। আপনাদের কমিশন থেকে এ ধরনের ঘটনার ব্যাপারে কোনো তদন্ত করছেন কি না?
নারায়ণচন্দ্র শীল  সীমান্তসংক্রান্ত বিষয়টি আন্তরাষ্ট্রীয়। এখানে ভারত ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনা করে বিষয়টির সুরাহা করবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মানবাধিকার কমিশনের এ নিয়ে কিছু বলার বা করার নেই। তবে কোনো বাংলাদেশি যদি পশ্চিমবঙ্গে এসে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে তা পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনার দেখবেন। আর বিএসএফ কাউকে মারলে সেটা দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের আওতা ও পরিধি ভাগ করা আছে। আন্তরাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে রাজ্য কোনো কিছু বলতে পারে না।
প্রথম আলো  কিন্তু একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আপনি বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
নারায়ণচন্দ্র শীল  অবশ্যই যেকোনো খুন কাম্য নয়, অন্যায়-অনভিপ্রেত। বিএসএফ যদি কোনো বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে থাকে, তাহলে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা। বিএসএফ যদি নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু করে, তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তি হওয়া উচিত।
প্রথম আলো  ‘যদি’ কেন বলছেন?
নারায়ণচন্দ্র শীল  যদি বলছি এ কারণে যে বিএসএফ কেন, কীভাবে গুলি করল। নিজের নিরাপত্তার জন্য মারল, না ইচ্ছা করে মারল, তা তো আমি নিশ্চিত না। এ নিয়ে কোনো তদন্ত হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে তা ঠিক করাই ভালো।
প্রথম আলো  তাহলে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সব আলোচনা কেন্দ্রীয়ভাবে সুরাহা করতে হবে বলে আপনি মনে করছেন?
নারায়ণচন্দ্র শীল  অনেকটা তা-ই। যেমন, আপনাদের গণমাধ্যম সীমান্ত হত্যা নিয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন কারাগারে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি আটক আছে। তা নিয়ে আপনাদের তেমন সোচ্চার দেখি না। এই বন্দীদের বিষয়টি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ভারতের কারাগারে আটক বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে দিতে আমি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে বারবার বলছি। আমরাও চাই না কোনো বাংলাদেশি ভারতের কারাগারে আটক থাকুক। আর যাঁরা আটক আছেন, তাঁরাও নিজ দেশে ফিরতে চান। কিন্তু এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হতে শুনছি না। বন্দিবিনিময়ে বেশ কিছু আইনি জটিলতা রয়ে গেছে। এগুলোর সমাধানের জন্য অনেক বেশি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
এমনও ঘটনা ঘটেছে, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছেন। সেখানে তাদের সন্তানও হয়েছে। পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর তাঁরা দুজন সন্তানসহ এখন কারাগারে। এখন ওই সন্তানের রাষ্ট্রীয় পরিচয় কী হবে। মা-বাবাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে ওই সন্তানের নাগরিকত্বের বিষয়টিকে কীভাবে সুরাহা করা হবে, তা নিয়ে জটিলতা রয়ে যাবে।
একবার এক আবাসিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, বাংলাদেশি একটি সাত বছরের শিশুকে নিয়ে কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়েছে। কারণ, পূজার ছুটির জন্য স্কুল ও হোস্টেল এক মাস বন্ধ। কিন্তু তার মা-বাবা তাকে নিতে আসেনি। এখন ওই শিশুটি কোথায় যাবে। কার তত্ত্বাবধানে থাকবে, তা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
প্রথম আলো  পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার কমিশন কোন বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব দেয়?
নারায়ণচন্দ্র শীল  আমাদের এখানে মানবাধিকার কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কোনো সাধারণ নাগরিকের মানবাধিকার লঙ্ঘন হলো কি না, তা নিয়ে বেশি কাজ করে থাকে। চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা হলে মানবাধিকার কমিশন তা তদন্ত করে দেখে। জনসেবা ও জন-অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো দায়িত্বহীনতা বা অবহেলা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার এখতিয়ার মানবাধিকার কমিশনের রয়েছে।
প্রথম আলো  আপনাদের ভূমিকা পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা রাখে। রাজ্য সরকার কি আপনাদের কথা শোনে, সুপারিশ মানে?
নারায়ণচন্দ্র শীল  সাধারণ নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনকে আমি ৯৯ শতাংশ সফল হিসেবে মূল্যায়ন করব। আমাদের বেশির ভাগ সুপারিশ রাজ্য সরকার অনুসরণ ও মূল্যায়ন করে। যেমন, আইজি পদমর্যাদার এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে অনৈতিক কাজের প্রমাণ পেয়েছি। বিষয়টি রাজ্য সরকারকে জানানোর পর ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রোগীদের অবহেলা করার প্রমাণ পাওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যবস্থা নিয়েছে।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
নারায়ণচন্দ্র শীল  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.