তেল-সংকট-জ্বালানি খাতে অশুভ সংকেত by পিটার কাস্টার্স

বছরের শুরুতেই লক্ষণটা অশুভ। জানুয়ারির তিন তারিখে খবর হলো যে, অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক দাম গত দুই বছরের মধ্যে চরমে পৌঁছেছে। অন্যদিকে অপরিশোধিত ব্রেন্ট তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি নয় হাজার ৪৮৪ ডলার হবে বলে জানিয়েছেন এক বিশ্লেষক।


তড়িঘড়ি করেই তিনি গত বছরের শেষাশেষি তেলের দাম ২০০ গুণ বেড়েছে বলে দেখান। স্মরণ করা দরকার, ২০০৮ সালের মাঝামাঝি তেলের দাম সর্বোচ্চ সীমায় ওঠার পরে ব্যারেলপ্রতি ১৪৮ ডলার—মন্দার সময়ে তা আবার নেমে ৩৫ ডলারে এসে ঠেকে।
তাহলেও, ২০০৮-এর মাঝামাঝি ও ২০১১-এর শুরুতে তেলের দাম সর্বোচ্চে ওঠার এই ঘটনা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বাভাবিক। অতীতে একবারই এ রকম অস্বাভাবিক দাম বেড়েছিল ১৯৭০ সালের শেষ থেকে ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে। এদিকে, বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১১ সালজুড়ে তেলের দাম মোটামুটি ব্যারেলপ্রতি ৮৭ ডলারই থাকবে। এর প্রতিক্রিয়ায় যে প্রশ্নটি ওঠানো দরকার তা হলো, আমরা কী এমন এক দামবৃদ্ধি দেখছি, যা বাজারের প্রবণতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? যেমন—চীনের তেলের চাহিদা বেড়েছে বলে? নাকি ফাটকা বাজারের কারবারিদের কারণে? অথবা আমরা মুখোমুখি হচ্ছি তেল উত্তোলন ও উৎপাদনের এক কাঠামোগত সংকটের?
তেলের দাম চরমে ওঠার পাশাপাশি আমরা দেখছি আরেকটি অশুভ লক্ষণ। আর এর জন্ম দিয়েছে আর কেউ নয়, স্বয়ং আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)। সংস্থাটির জন্ম হয়েছিল ১৯৭০ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের বিপরীতে। আইইএ মূলত পাশ্চাত্যের তেল ক্রয়কারী দেশগুলোর স্বার্থরক্ষাকারী দেশগুলোর সংস্থা। গত বছরের নভেম্বর মাসের গোড়ায় আইইএ তাদের বার্ষিক বৈশ্বিক জ্বালানি অবস্থা শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন ও সরবরাহ বিষয়ে এই প্রতিবেদনটিকে পশ্চিমা বিশ্ব আস্থার সঙ্গে গ্রহণ করে। অথচ প্রতিবেদনটিতে বিশ্বের পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর জ্বালানি নীতিমালাকে নতুনভাবে রচনা করার বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখায়। আইইএর সমালোচকেরা সুযোগটি হাতে নেয় এবং তাদের প্রতিবেদনের সবচেয়ে দুর্বল দিকটিতে আলোকপাত করে। সেটা হলো, আইইএ তার ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো জানায় যে, চার বছর আগেই প্রচলিত অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন সর্বোচ্চ দশায় পৌঁছে, অর্থাৎ দৈনিক তিন কোটি ব্যারেল। প্রচলিত অপরিশোধিত তেল বলতে বোঝায় যে তেল সাধারণ খনন পদ্ধতিতে তোলা হয়েছে।
২০১০-এর বৈশ্বিক জ্বালানি অবস্থা শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রচলিত অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন আসলে শীর্ষে পৌঁছায় ২০০৬ সালে। পরিষ্কারভাবে, তখন তেলের বাজারের ওপর চাপ এখনকার থেকে দ্বিগুণ ছিল। আর এখন আমরা কেবল তেলের দামের সর্বোচ্চ বৃদ্ধির ফলই দেখছি না কেবল, তেলের উৎপাদনেরও সর্বোচ্চে ওঠার প্রতিক্রিয়ার কবলে পড়েছি।
যাঁরা এত সব গোলমালে বিরক্ত হতে চান না, তাঁরা ভাববেন ‘পিক অয়েল’ (তেলের উৎপাদন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানো নিয়ে বিতর্ক) বিতর্ক নতুন কিছু নয়। কিন্তু আইইএ কেন অনুমোদন দিল? এটা কি নাটকীয় নয়? ঠিক যে, বিশ্লেষকেরা কয়েক দশক ধরেই পিক অয়েল নিয়ে তর্ক করে যাচ্ছেন। ১৯৭০ সালের দিকে এখনকার বিখ্যাত তেল ভূ-তত্ত্ববিদ কিং হুবার্ট এই ধারণা সামনে এনেছিলেন যে মাটির বুক থেকে তেল উত্তোলন করার একটা সীমা আছে, যার পরে আর করা যাবে না। কেবল আলাদা আলাদা খনিই শূন্য হয়ে যাবে না, বিভিন্ন দেশের এমনকি আন্তর্জাতিক তেলভান্ডারও শূন্য হতে থাকবে এবং উৎপাদন চিরকালের মতো কমতির দিকে যাবে। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত হুবার্টের চিন্তা বিতর্কিত ছিল। তার পরও তখন থেকেই পশ্চিমের প্রধান প্রধান বিশ্লেষকেরা ‘পিক অয়েল’-এর অপ্রতিরোধ্যতা নিয়ে গভীরভাবেই বিতর্ক করে আসছেন। তাহলেও বিশ্লেষক ও অন্যরা কখন সেই পতন শুরু হবে, তা নিয়ে কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারেননি। কায়েমি স্বার্থের পক্ষপাতী এবং তেল কোম্পানিগুলোর পক্ষের লোকেরা বলার চেষ্টা করেছেন যে, সেই পতন ২০২০-৩০-এর আগে হবে না। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, তা আরও আগেই হতে পারে। আইইএর স্বীকৃতিতে তারই প্রমাণ মিলল।
তারা এখন বলছে, অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন এখন ঢালু গতিতে নামছে। অবশ্য হুবার্ট যেমনটা বলেছেন, সাধারণ তেলের উৎপাদনে সে রকম মন্দা এখনো আসেনি। যে আইইএ এত দিন ‘পিক অয়েল’-এর সমালোচক ছিল, তারাই এখন তা স্বীকার করে নেওয়ায় যারা হুঁশিয়ার করেছিল, তারাই সঠিক প্রমাণিত হলো।
কিন্তু এই স্বীকৃতির তাৎপর্য কী? পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের তিনটি ঝোঁকের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, প্রচলিত তেলের সন্ধান আরও জোরদার করা। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেলভান্ডারের ওপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এরই অংশ। কিন্তু এর ফল হয়েছে উল্টো। এখন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির একটি অংশও বলা শুরু করেছে যে, ইরাক যুদ্ধ ছিল এক ব্যর্থ অভিযান। দ্বিতীয় ঝোঁক হলো, তেলের অপ্রচলিত উৎসগুলোর ওপর নির্ভরতা বাড়ানো। যেমন—পাথরের গঠনের ভেতর থেকে তেলের উপাদান সংগ্রহ এবং বালু থেকে তেল বের করা, যেটা এখন উত্তর কানাডায় করা হচ্ছে। একটা সীমিত সময়ের জন্য এভাবে বিশ্বের তেলভান্ডারকে কিছুটা বাড়ানো যাবে। তাহলেও, বালু থেকে তেল বের করার প্রক্রিয়া তরল তেল উত্তোলনের থেকে বহুগুণ বেশি খরুচে। আবার এর জন্য দরকার অঢেল পানি, যা থেকে আবার জন্ম নেবে বিপুল বর্জ্য। তৃতীয় সম্ভাবনাটির দিকে ঝুঁকেছিল ওবামা সরকার, ২০১০ সালের প্রথম দিকে। সেটা হলো, তেল কোম্পানিগুলোকে গভীর সমুদ্রে কূপ খননের অনুমতি দেওয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের খুবই কাছে মেক্সিকো সাগরে কূপ খনন করতে গিয়ে যে বিরাট বিপর্যয় হলো, তাতে এই সম্ভাবনার পথেও কাঁটা পড়ল। এ থেকে দেখা গেল, গভীর সমুদ্রের খনন হলেও তা হবে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে। এতে অন্য অর্থনৈতিক খাত, যেমন—মৎস্য, পর্যটন ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির শিকার হতে পারে।
তাক লাগানোর মতো ব্যাপার, আইইএ পরোক্ষভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, বিশ্বের অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটাতে হবে এবং আমাদের ক্রমশই নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। যেমন—বাতাস, সৌরশক্তি, জৈব ও ভূশক্তি (জিওথার্মাল)। প্রচলিত তেল উৎপাদন চরমসীমায় পৌঁছানোর স্বীকৃতির মতোই বিকল্প শক্তির সন্ধানের এই তাগাদা আসলেই নাটকীয়। কেননা, যে জ্বালানির জন্য পাশ্চাত্য তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে, তারাই এখন বাস্তবতার চাপে বাধ্য হচ্ছে অন্য ধরনের জ্বালানি-বন্দোবস্ত সৃষ্টি করতে। একই সঙ্গে এটাও সত্য যে আইইএ বর্তমান শিল্পোৎপাদনের ধরন নিয়ে কোনো কথা বলেনি, বলেনি বিকল্প জ্বালানি উৎস সন্ধানে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও উদ্যোগের প্রয়োজনের কথা। এটুকু স্বীকৃতিও ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তার পরও প্রচলিত তেলের যুগ শেষ এবং খননের মাধ্যমে আর সস্তায় তেল পাওয়া যাবে না, এমন লক্ষণ এখনো পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.