আজ ও কাল হরতাল

বিরোধীদলীয় নেতার বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সরকার ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসারের সন্ধান দিতে না পারায় আজ রবিবার ও কাল সোমবার সারা দেশে আবারও সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দুই দিনের হরতাল ঘোষণা করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ইলিয়াসকে না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।


ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়াই হলো সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। তিনি বলেন, 'আমরা এখনো আশাবাদী, সরকার ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেবে। অন্যথায় সরকারই বিপদে পড়বে। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।'
গতকাল শনিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে এর আগে ২২ থেকে ২৪ এপ্রিল তিন দিন সারা দেশে হরতাল পালন করে বিএনপি। এ ছাড়া ২০ এপ্রিল সিলেট অঞ্চলের চার জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হয়। গত ২৪ এপ্রিল হরতাল শেষে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারকে শনিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে বলেছিলেন, এই সময়ের মধ্যে ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে না দিলে রবিবার থেকে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে তাঁর দল।
পরীক্ষায় ক্ষতি হচ্ছে তা বুঝি : সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, 'এইচএসসি পরীক্ষায় ক্ষতি হচ্ছে, তা আমরা বুঝি। কিন্তু ইলিয়াস আলী অনেক বড় নেতা। তাঁকে ফিরে পাওয়ার সঙ্গে অনেক বড় জাতীয় স্বার্থ নিহিত রয়েছে। গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না, সে প্রশ্নও জড়িত।'
মে দিবসের কারণে টানা কর্মসূচি দেওয়া গেল না : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, 'মে দিবসের কারণে একটানা কর্মসূচি দেওয়া গেল না। সোমবার হরতালশেষে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ইলিয়াস আলীকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলতেই থাকবে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা যেকোনো বিষয়েই সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনায় প্রস্তুত। কিন্তু আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই।'
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফরকালে কোনো হরতাল থাকবে কি না, জানতে চাইলে সরাসরি জবাব না দিয়ে ফখরুল বলেন, 'বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওয়েল বাংলাদেশ সফর আসতে চাইলে আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল। কিন্তু আমরা এমন কর্মসূচি দেব না, যাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।'
ইলিয়াসকে পেলেই কর্মসূচি প্রত্যাহার : মির্জা ফখরুল বলেন, 'বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানোর জন্য সরকার ইলিয়াস আলীকে ফেরত না দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা সরকারকে বলতে চাই, তাঁকে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে দিন। নইলে এর পরিণতি শুভ হবে না।' তিনি বলেন, 'যে মুহূর্তে ইলিয়াস আলীকে জীবিত পাওয়া যাবে, সে মুহূর্তেই আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হবে।' তিনি দাবি করেন, গত তিন বছরে সরকার ১২৭ জন রাজনৈতিক কর্মীকে গুম করেছে।
গতকাল দেশব্যাপী বিক্ষোভ চলাকালে সারা দেশে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার এবং ৮৮ জনকে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে বলে ফখরুল অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমানউল্লাহ আমান, জামায়াতের মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, বিজেপির শামীম আল মামুন, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ নবগঠিত ১৮ দলীয় জোটের নেতারা।
অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই হরতাল : এদিকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল হরতাল না দেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির ওপর চাপ প্রয়োগ করে। বিষয়টি জেনেও বিএনপি হরতাল দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশি-বিদেশি ও ব্যবসায়ী মহলের হরতাল না দেওয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও আলটিমেটাম শেষে বাধ্য হয়েই হরতাল দিতে হলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির আরেক নেতা বলেন, হরতাল কতটা সফল হবে কিংবা ১৮ দলীয় জোটের নেতারা মাঠে থাকতে পারবেন কি না, সেটাও বড় কথা নয়। বলা হয়েছিল রবিবার থেকে কঠোর আন্দোলন শুরু হবে, তাই অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এই হরতাল।
গত ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর মহাখালী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসার। ওই রাতেই ইলিয়াসের বাসার কাছে আমতলী থেকে তাঁর গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
বিএনপি কার্যালয়ের সামনে মিছিল : এদিকে ইলিয়াস আলীকে ফেরত পাওয়ার দাবিতে দেশজুড়ে থানায় থানায় বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট তিনটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলগুলো বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই শেষ হয়। অন্যদিকে সকাল থেকেই বিএনপি কার্যালয়ের সামনে র‌্যাব-পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
জিয়ার কবরে ফুল : আগের হরতাল চলাকালে আটক হয়ে মুক্তি পাওয়া জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের নেতাদের নিয়ে জিয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জামিনে মুক্তি পাওয়া নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি নুরী আরা সাফা, সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, জেবা খান, সুলতানা আহমেদ, সাহিদা আখতার রিতাসহ ১৫ জন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, 'রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ও মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সাহেবরা বলছেন, তাঁদের নিরাপত্তা নেই। রাজনীতিকে এভাবে গুম করে সরকার গণতন্ত্রকে গুম করছে।' তিনি বলেন, সরকার সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ হত্যাসহ কোনো হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করতে পারেনি।
হরতাল সফল করার আহ্বান শরিকদের : হরতাল সফল করার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির সঙ্গে যৌথভাবে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ জানান, আজ জামায়াতের নেতা-কর্মীরা রাজধানীর কমপক্ষে ২৫টি স্পটে পিকেটিংয়ে থাকবে। তিনি বলেন, জামায়াত জোটবদ্ধভাবে কর্মসূচি দিয়েছে, তাই জোটবদ্ধভাবেই রাজপথে থাকবে।
এদিকে খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলান মোহাম্মদ শফিক উদ্দিন গতকাল এক বিবৃতিতে আজ ও কালকের হরতাল সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, হরতালে বাধা দিলে আরো কঠিন কর্মসূচি দেওয়া হবে।
আগুন আতঙ্ক : বিরোধী দলের দুই দিনের হরতাল ডাকার পরই গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর রাজপথে 'আগুন আতঙ্কে' যানবাহনের চলাচল কমে যায়। গত সপ্তাহে হরতালের আগে বাসে আগুন ও এক চালকের মৃত্যুর ঘটনায় এবারের হরতাল নিয়েও শঙ্কায় ছিল রাজধানীবাসী। এরই মধ্যে গতকাল বিকেলে নীলক্ষেত মোড় এলাকায় একটি বাসে যাত্রীবেশে উঠে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে কয়েকজন যুবক। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে আগুন আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। বিকেলে আতঙ্কে রাস্তায় বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন কমে গেলে দুর্ভোগে পড়ে ঘরমুখো কর্মজীবী মানুষ।
গতকাল রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত নীলক্ষেত মোড় ছাড়াও ফকিরাপুল এলাকায় একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে আর কোথাও বাসে আগুনসহ কোনো রকম নাশকতার খবর পাওয়া যায়নি।
গতকাল দুপুর থেকে বাসে আগুন বা কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে পুলিশ ও র‌্যাবের টহল ছিল চোখে পড়ার মতো।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আজিমপুর থেকে গাজীপুরগামী ২৭ নম্বর রুটের একটি বাসে কয়েকজন যুবক যাত্রীবেশে ওঠে। বাসটি আজিমপুর থেকে নীলক্ষেত মোড় এলাকায় পেঁৗছাতেই তারা পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে নেমে পড়ে। যাত্রীরা 'আগুন আগুন' চিৎকার দিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ে। এ ঘটনার আশপাশের সড়কে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই এলাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে থাকা লালবাগ থানার উপপরিদর্শক নূরুল আলম জমাদ্দার কালের কণ্ঠকে জানান, পেট্রল ঢেলে সিটে আগুন দেওয়ার পর বাসের যাত্রী, স্টাফ, পুলিশ ও জনগণ তা নিভিয়ে ফেলে।
বিকেল ৪টার দিকে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট এলাকায় একটি বাসে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে কিছু যুবক। স্থানীয় সূত্রে এ খবর পাওয়া গেলেও পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস তা নিশ্চিত করেনি। মোহাম্মদপুর থানার ডিউটি অফিসার আফজাল হোসেন বলেন, 'আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। তবে রাস্তায় আমাদের ফোর্স সতর্ক অবস্থানে আছে।'
গতকাল বিকেলে প্রেসক্লাব মোড়, শাহবাগ, কাকরাইল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মহাখালী, বনানী, নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাবসহ প্রধান প্রধান পয়েন্টগুলোতে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা গেছে। কারওয়ান বাজার এলাকায় বাসের জন্য অপেক্ষমাণ মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা সোহরাব হোসেন ও মোস্তফা আকবর বলেন, বিকেল ৩টা থেকেই রাস্তায় বাস নেই। মাঝেমধ্যে দু-একটা যা আসছে তাও ভিড়ে ঠাসা। ফার্মগেট এলাকায় ৬ নম্বর বাসের চালক মোতাহার হোসেন বলেন, 'হরতালের কারণে অনেকেই চলার শিডিউল বাতিল কইরা দিছে। এই কারণে গাড়ি কম।'
ঘরমুখো মানুষের অনেকেই জানায়, রাস্তায় যানবাহনে ভাঙচুর বা আগুনের ভয়ে আগেভাগেই তারা বাসায় যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হয়। বিকেলে রাস্তায় কমে যায় বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ফকিরাপুলের বঙ্ কালভার্ট এলাকায় একটি মাইক্রোবাস থামিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েক যুবক। পরে পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন গাড়িটির আগুন নিভিয়ে ফেলে।
মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বাসে আগুনসহ সব ধরনের নাশকতা মোকাবিলায় গতকাল দুপুর থেকেই রাজধানীর ৪৭টি থানার অতিরিক্ত টহলদল মাঠে কাজ করছে। আজ হরতালের সময় একইভাবে মাঠে থাকবে পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.