অগ্রক্রয়ের দাবি কীভাবে করবেন? by তানজিম আল ইসলাম

সেলিম ও আশরাফ দুই ভাই। তাঁদের এক বোন। বাবা-মা জীবিত নেই। বাবার সম্পত্তি ওয়ারিশসূত্রে পেয়েছেন তাঁরা। বণ্টননামা অনুযায়ী, যে যাঁর অংশ বুঝে নিয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে কৃষিজমি রয়েছে। সেলিম তাঁর প্রাপ্য কৃষিজমিটুকু বেচে দেওয়ার জন্য বায়না করেন একজন ক্রেতার সঙ্গে। আশরাফ তা জানতে পারেন।
আশরাফ ভাবেন, পৈতৃক সূত্রে সম্পত্তি ভাইয়ের হলেও অন্য লোকেরা এসে এ জমি ভোগদখল করবে, এটা হতে দেবেন না। তাই আশরাফ ভাবলেন, তিনি নিজেই সম্পত্তি কিনে নেবেন। কিন্তু উপায় কী, জমি তো বিক্রি হয়ে গেছে। এখন এ জমি আবার তিনি কিনবেন কী করে?
আইন অনুযায়ী, আশরাফ সাহেবের জমি কেনার অধিকার আছে। যাকে বলা হয় প্রি-অ্যামশন বা অগ্রক্রয়। মুসলিম আইন অনুযায়ীও এর স্বীকৃতি আছে। বিধিবদ্ধ আইনে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের (সংশোধনী ২০০৬) ৯৬ ধারায় এর উল্লেখ আছে। এই আইন অনুযায়ী, উত্তরাধিকার সূত্রে যদি কেউ সহ-শরিক হয়, তাহলে প্রি-অ্যামশন বা অগ্রক্রয় মিস কেইস (বিবিধ মামলা) করতে পারবে। তবে উত্তরাধিকার ছাড়া ক্রয়সূত্রে যা অন্য সহ-শরিকেরা এ মামলা এই আইন অনুযায়ী করতে পারবেন না।
তবে কিছু শর্ত মানতে হবে উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিককে। যেমন, যেদিন জমি বিক্রয় হয়েছে, এ খবর শোনার দিন থেকে দুই মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। নিয়ম হচ্ছে, রেজিস্ট্রেশন আইনের ৮৯ ধারা অনুযায়ী সহ-শরিকদের (উত্তরাধিকার সূত্রে) ওপর নোটিশ দিতে হয়। এ অনুযায়ী নোটিশ পাওয়ার পরও দুই মাসের মধ্যে অগ্রক্রয়ের মামলা করতে হয়।
এ মামলায় যতজন সহ-শরিক থাকে (উত্তরাধিকার সূত্রে) এবং ক্রেতা সবাইকে পক্ষভুক্ত করতে হয়। আদালতে মামলা দাখিল করার সময় কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিতে হবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ হচ্ছে দলিল রেজিস্ট্রি করার সময় সম্পাদনের সময় যে বিক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে, সে পরিমাণ অর্থ। বিক্রয় দলিল সম্পাদনের যে পরিমাণ অর্থের উল্লেখ আছে, সে পরিমাণ অর্থের ওপর শতকরা ২৫ ভাগ হারে ক্ষতিপূরণ। বিক্রয় দলিল সম্পাদনের তারিখ থেকে অগ্রক্রয় মোকদ্দমা দায়ের করার তারিখ পর্যন্ত সময়ের জন্য বার্ষিক শতকরা আট টাকা হারে সরল সুদে বিক্রয় দলিলের উল্লিখিত টাকার ওপর যত টাকা আসে, সে পরিমাণ টাকা। আবেদন এবং উক্ত নির্ধারিত টাকা জমা দেওয়ার পর আদালত সমন দেবেন এবং ক্রেতা সহ-শরিকদের হাজির হতে বলবেন। ক্রেতা খাজনা এবং অন্যান্য যত টাকা খরচ হয়েছে, তা জানাতে ক্রেতাকে নির্দেশ দেবেন। আদালত এর পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনকারীকে আরও অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমাদানের নির্দেশ দিতে পারেন। যদি এমন হয়, বাকি উত্তরাধিকারী যারা আছে, তাদের পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তাদের ৮৯ ধারায় নোটিশ কিংবা জমি বিক্রির কথা জানার দুই মাসের মধ্যে আবেদন করতে হবে। তা না হলে তাদের অধিকার হারাবে। আদালত এর পরিপ্রেক্ষিতে টাকা জমাদানের নির্দেশ দেবেন।
একাধিক পক্ষের টাকা ভাগাভাগি করে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দিতে পারেন। আদালত সন্তুষ্ট হলে এবং শুনানির শেষে আবেদনকারীকে জমি কেনার অধিকার দিতে পারেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জমা দেওয়া টাকা থেকে ক্রেতাকে তার পাওনা টাকা পরিশোধ করতে আদেশ দেবেন। যার আবেদন মঞ্জুর করা হলো তার বরাবর ৬০ দিনের মধ্যে বিক্রয় দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেবেন। তবে এ রেজিস্ট্রেশনের জন্য কোনো কর ডিউটি বা ফিস দিতে হবে না। ৬০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রি করে দিতে ব্যর্থ হলে এর পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সাফকবলা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দেবেন আদালত। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে আইনে। তবে এ নিয়মগুলো শুধু কৃষিজমির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

অকৃষিজমির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়
যেসব জমি কৃষিজমি নয়, অর্থাৎ বসতভিটা, আবাসিক এলাকা, শিল্পভিত্তিক জমি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহ-শরিকদের অগ্রক্রয়ের অধিকার আছে। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিক হতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ক্রয়সূত্রে কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে সহ-শরিকেরাও অকৃষিজমিতে অগ্রক্রয়ের অধিকার ফলাতে পারবে। এটি অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনে ১৯৪৯-এর ২৪ ধারায় উল্লেখ আছে। এখানেও কিছু শর্ত পালন করতে হয়। যেমন জমি রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে ২৩ ধারামতে নোটিশ দেওয়ার নিয়ম আছে। এ নোটিশ পাওয়ার কিংবা জমি বিক্রয়ের খবর জানার পর থেকে চার মাসের মধ্যে
অগ্রক্রয় মামলা করতে হবে। এর সঙ্গে বিক্রয় দলিলে উল্লিখিত টাকার সঙ্গে শতকরা ৫ ভাগ হারে ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিতে হবে। তবে এমন হতে পারে যে ওই জমিতে ক্রেতা কোনো কাজ করছে বা দালানকোঠা তৈরি করছে, সে ক্ষেত্রে আদালত এর ওপর ভিত্তি করে একটি ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করে দিতে পারেন। এর ক্ষেত্রে আদালত সময়সীমা বেঁধে দেবেন। পৌর এলাকার ভেতর কোনো জমি সব সময় অকৃষিজমি হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী, ৯৬ ধারায় মামলা করা যাবে না।

মুসলিম আইনেও আছে অধিকার
কোনো জমিতে উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিক ছাড়াও অন্য সহ-শরিকেরা মুসলিম আইন অনুযায়ী অগ্রক্রয় মামলা করতে পারবে। প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৬ ধারা অনুযায়ী শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিকদেরই মামলা করার অধিকার আছে। কিন্তু মুসলিম আইন অনুযায়ী, সব সহ-শরিকই মোকদ্দমা করতে পারবে। একে ‘শুফা’ অধিকারের মামলা বলা হয়।

যেসব ক্ষেত্রে দাবি করা যাবে না
হেবাকৃত সম্পত্তি, উইলকৃত সম্পত্তি, দেবোত্তর বা ওয়াকফকৃত জমি, খাই খালাসি বন্ধকের মাধ্যমে জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে, আপসমূলে ডিক্রিপ্রাপ্ত জমি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় চলে না। যাদের ৬০ বিঘা জমি আছে, তারাও অগ্রক্রয়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। ৬০ বিঘার কম আছে, কিন্তু ৬০ বিঘা থেকে যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু জমির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় প্রয়োগ করা যাবে।
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.