৪১ বাংলাদেশির মৃত্যুদণ্ড, বিচার চলছে ৫০ জনের by শরিফুল হাসান

ভাগ্যবদলের স্বপ্নে তিন বছর আগে বাহরাইনে গিয়েছিলেন ২২ বছরের রাসেল। কিন্তু বিদেশি এক নাগরিককে খুনের দায়ে এখন তিনি মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি। যেকোনো সময় তাঁর দণ্ড কার্যকর হতে পারে। রাসেলের মতো একই পরিণতির মুখোমুখি সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা আরও ৪০ বাংলাদেশি।


এ ছাড়া খুনের অপরাধে বিচার চলছে আরও অন্তত ৫০ বাংলাদেশির। রাসেলের বাবা মিজানুর রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, জমিজমা বিক্রি করে অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ছেলেটা এমন ভুল করবে, তিনি কখনো ভাবেননি।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে সৌদি আরবে ১৩ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৫, কুয়েতে ১০ এবং বাহরাইন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে তিন বাংলাদেশি রয়েছেন, যাঁদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। এঁদের মধ্যে ১২ জনই বিদেশি নাগরিক হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। আর বাকিরা খুন করেছেন নিজের দেশের নাগরিকদের।
গত বছর সৌদি আরবে একসঙ্গে আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করা হয়। সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর সরকার বিদেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কিংবা খুনের অপরাধে বিচার চলছে—এমন বাংলাদেশিদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত জোগাড়ের উদ্যোগ নেয়। কয়েক মাস ধরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং বিভিন্ন দূতাবাসে খোঁঁজ নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, একজনের জন্য বিপদে পড়ে অনেকে। আমরা প্রবাসীদের বারবার বলছি, কোনো অপরাধে জড়াবেন না। আর বাংলাদেশ থেকে কোনো অপরাধী যেন বিদেশে যেতে না পারে, সে ব্যাপারেও আমরা সচেতন আছি।’
বিএমইটির পরিচালক (কল্যাণ) মোহসিন চৌধুরী বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে খুনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হয়। এ ক্ষেত্রে যে খুন হয়েছে, তার পরিবার চাইলে অনেক সময় খুনিকে জরিমানা বা ব্লাডমানি নিয়ে ক্ষমা করতে পারে। আর বাংলাদেশি কোনো নাগরিক খুন হলে দুই পরিবারের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সৌদি আরব: সৌদি আরবে মোট ১৩ জন বাংলাদেশি মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি। যেকোনো সময় তাঁদের শিরশ্ছেদ হতে পারে। এ ছাড়া খুনের অপরাধে বিচার চলছে আরও অন্তত ১৫ জনের।
বিএমইটি ও সৌদি দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, রিয়াদে ভারতীয় এক নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার লিটন নামের একজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে। লিটনের পক্ষ থেকে ভারতীয় ওই পরিবারের কাছে আবেদন করা হলে তারা ক্ষমা করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। ফলে যেকোনো সময় লিটনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে।
আলী আবদুল্লাহ মোহাম্মদ নামের এক সৌদি নাগরিককে হত্যার দায়ে নরসিংদীর আবু বকরের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আবদুল্লাহর পরিবার জানিয়েছে, ৩০ লাখ সৌদি রিয়াল পেলে তারা ক্ষমা করতে রাজি। এ বছরের ৮ অক্টোবরের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে বকরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে।
জেদ্দায় পাকিস্তানের নাগরিক এজাজকে হত্যার দায়ে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আখতার হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আখতারের বোন হাসমত আরা প্রথম আলোকে জানান, নিহত পাকিস্তানির পরিবারকে ৮০ লাখ টাকা দিতে পারলে নাকি তাঁর ভাই রক্ষা পাবেন। কিন্তু তাঁরা অতি দরিদ্র। তাঁদের পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়।
পিরোজপুরের আবদুল মান্নানকে ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রিয়াদে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন চট্টগ্রামের ফটিখছড়ির নূরউদ্দিন। আদালত নূরউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। নিহত ব্যক্তির পরিবার ক্ষমা না করলে যেকোনো সময় নূরউদ্দিনের দণ্ড কার্যকর হবে। ২০০৪ সালে পাবনার মিজানুর রহমানকে হত্যার ঘটনায় চাঁদপুরের হায়দার আলী ও পাবনার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুদণ্ড হয়।
২০০৭ সালের ১ জুলাই মানিকগঞ্জের দেলোয়ার হোসেনকে হত্যার দায়ে একই এলাকার আবদুস সালামের মৃত্যুদণ্ড হয়। নিহত দেলোয়ারের ভাই আবদুর রকিব জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা খুনিকে ক্ষমা করবেন না। ফলে যেকোনো সময় তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে।
হবিগঞ্জের বিল্লাল হোসেনকে মাথায় ভারী যন্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড হলেও তিনি এখন পলাতক।
ঢাকার শাহিন নামের এক লোককে হত্যার ঘটনায় নুজুম ও আবদুল মজিদ নামের দুই বাংলাদেশির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই পরিবারের কাছে ক্ষমার জন্য চিঠি দেওয়া হলেও তারা ক্ষমা করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার দুই নাগরিক ও লক্ষ্মীপুরের আবুল কাশেম নামের এক প্রবাসীকে হত্যার দায়ে বিচার চলছে ভোলার আবুল কালামের। জেদ্দাপ্রবাসী এক বাংলাদেশির স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যার দায়ে ঢাকার দোহারের গোলাম হায়দারের বিচার চলছে। এ ছাড়া পৃথক খুনের মামলায় ময়মনসিংহের রফিকুল ইসলাম, কুমিল্লার আবদুস সালাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোশারফ হোসেনসহ আরও অন্তত ১০ জনের বিচার চলছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এঁদের মৃত্যুদণ্ড হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত: ভারতীয় এক নাগরিককে হত্যার দায়ে পাবনার নায়েব আলী, ময়মনসিংহের কামরুল ইসলাম ও কুমিল্লার আতিক আশরাফকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আমিরাতের আদালত। পরে আপিল বিভাগেও মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে।
ভারতীয় এক নাগরিককে হত্যার দায়ে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের কফিলউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে শারজাহ শরিয়া বোর্ড। নিহতের পরিবার জানিয়েছে, ৪৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেলে তারা কফিলকে ক্ষমা করতে পারে।
তৈয়ব ও আয়ুব নামে দুই ভাইকে হত্যার দায়ে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের হারুনুর রশিদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন রাস আলখাইমা শরিয়াহ আদালত। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নিহতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা ক্ষমা করতে রাজি হয়নি।
এ ছাড়া আরব আমিরাতের এক বৃদ্ধাকে হত্যার দায়ে ফেনীর জয়নাল আবেদিন, ফিলিপাইনের এক নাগরিককে হত্যার দায়ে মৌলভীবাজারের সাদেকুর রহমান, পাকিস্তানি এক নাগরিককে হত্যার দায়ে সিলেটের গোয়াইনঘাটের হেলালউদ্দিন ও সমীর রায়ের বিচার চলছে শারজাহ শরিয়াহ আদালতে।
কুয়েত: ঢাকার দোহারের ফজলকে হত্যার দায়ে জামালপুরের আবদুল আলিম, মাগুরার তবিবুর বিশ্বাস ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মকবুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ছেন কুয়েতের শরিয়াহ আদালত। ফজলের বাবা সামসুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান। আর অভিযুক্ত তিন পরিবার চায় ক্ষমা। একইভাবে মানিকগঞ্জের মোহিদুরকে হত্যার দায়ে মুন্সিগঞ্জের ইকবাল হোসেন, হূদয় ও রমজানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাদত মিয়াকে হত্যার দায়ে একই জেলার রিনু মিয়ার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।
মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর: জুরিয়াতি বিনতি নামে এক তরুণীকে হত্যার দায়ে পাবনার শামীম রেজার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার এক গৃহকর্মীকে হত্যার দায়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কামরুল হাসানের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন সিঙ্গাপুরের আদালত।
এ ছাড়া কাতার ও মিসরেও একই অভিযোগে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আবার কয়েকজনের বিচার চলছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গুটিকয়েক বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নেতিবাচক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে সবাইকে। আবার শ্রমবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কাউকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ানোর জন্য তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.