অচলাবস্থা-প্রধানমন্ত্রী, বুয়েটকে রক্ষা করুন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) একটি স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ। কিন্তু এর বর্তমান উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। বুয়েটের মর্যাদা ও উৎকর্ষ রক্ষার্থে ৭ এপ্রিল থেকে শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন।


আমি বুয়েটের ছাত্র ছিলাম, স্যারদের খুব কম সময়ে দেখেছি ক্লাসে দেরি করে আসতে বা ক্লাস না নিতে। কখনো হরতালের কারণে ক্লাস নিতে না পারলে বন্ধের দিনেও ক্লাস নিতে দেখেছি। বুয়েট ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেককেই দেখেছি একই সঙ্গে ভোট চাইতে, তারপর একই টেবিলে বসে চা খেতে, পড়তে। নির্বাচনের আগে ভিপি-জিএস প্রার্থীদের বিতর্ক হতো, সেখানে তাঁরা নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করতেন এবং ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
ভর্তি হওয়ার পরে জেনেছি, বুয়েটে মেধাক্রম অনুসারেই শিক্ষক নিয়োগ হয়। আমিও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম এবং পরে ক্লাসে প্রথম হয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, একাডেমিক ব্যাপারে সচেতনতা লক্ষ করেছি। বুয়েটের শিক্ষকেরা রাজনীতিসচেতন হলেও বুয়েটের সুনাম ও ঐতিহ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমকে দল-মত ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ঊর্ধ্বে রেখেছেন।
তারপর উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে চলে যাই। উচ্চশিক্ষা শেষে ফিরে আসার পর বুঝলাম, যে বুয়েট রেখে গিয়েছিলাম, তা আর নেই। ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতির হীন প্রয়োগ, ভোল পাল্টানো সংস্কৃতি এখানেও প্রবেশ করেছে। বুয়েটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ ‘উপ-উপাচার্য’ পদে ৫৮ জন শিক্ষককে ডিঙিয়ে ৫৯তম জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি তখনো তাঁর অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালনের মতো জ্যেষ্ঠতা অর্জন করেননি। এমনকি সে সময়ে প্রায় ৪০ জন সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকের তালিকায়ও তিনি ছিলেন না। আরও পরিতাপের বিষয়, বর্তমান উপাচার্য যোগদানের পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যাপক রদবদল শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় রেজিস্ট্রারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়মবহির্ভূত হস্তক্ষেপ করেন। উল্লেখ্য, রেজিস্ট্রার পদাধিকারবলে একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিন্ডিকেটের সদস্যসচিব। অথচ একাডেমিক কাউন্সিলে একজন শিক্ষক ন্যূনতম সহযোগী অধ্যাপক (যিনি ন্যূনতম পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং ন্যূনতম সাত বছর প্রত্যক্ষভাবে বুয়েটে শিক্ষকতা করেছেন) না হওয়া পর্যন্ত সদস্য হতে পারেন না।
বুয়েটের প্রধান গর্ব—পরীক্ষা-পদ্ধতি, শিক্ষক নিয়োগ ও একাডেমিক কার্যক্রমে বর্তমান উপাচার্যের হস্তক্ষেপের কতিপয় নজির তুলে ধরছি। একজন ছাত্র রেজিস্ট্রিকৃত একটি কোর্সে পরীক্ষা দিতে না পারায় উপাচার্যের বরাবর আবেদন করে। নিয়ম অনুযায়ী উপাচার্য তাঁর আবেদন বিবেচনার জন্য একাডেমিক কাউন্সিলে পাঠাবেন। কিন্তু উপাচার্য নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজেই তা মঞ্জুর করেন এবং তাঁর রেজিস্ট্রিকৃত বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সেমিস্টারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষকদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হন। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর সেই ছাত্রের ফলাফলের অসংগতি দূর করা হলেও কমিটির রিপোর্টটি আজও প্রকাশ করা হয়নি। এই একটি মাত্র ঘটনাই বুয়েটের এত দিনের অর্জন, ঐতিহ্যকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয় কি?
শিক্ষক নিয়োগে উচ্চতর যোগ্যতার প্রার্থীকে বাদ দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। কিছুদিন আগে বুয়েটের একটি ইনস্টিটিউটে প্রভাষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাক্রম অনুসারে চতুর্থ জিপিএধারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য আর কী বাকি রইল?
কিছুদিন আগে কতিপয় ছাত্রের চাঁদাবাজির কারণে বুয়েটের একটি হলের ক্যানটিন নজিরবিহীনভাবে অনেক দিন বন্ধ ছিল। ক্যানটিনের ম্যানেজার কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়ে কোনো প্রতিকার পাননি। কারণ, ওই ছাত্ররা বর্তমান উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের আশীর্বাদপুষ্ট।
এ বছরের শুরুতে কোনো এক ছাত্র হলে সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে জুনিয়র কয়েকজন ছাত্র শেষ বর্ষের এক ছাত্রকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন ওই ছাত্রদের শাস্তির দাবিতে। তখন কর্তৃপক্ষ দোষী ছাত্রদের বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত উপাচার্য ছাত্রদের দাবি মানতে রাজি হন এবং ওই দোষী ছাত্রদের বহিষ্কার করেন। কিন্তু সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ আন্দোলনসংশ্লিষ্ট প্রায় ৩০ জন ছাত্রের ফল আটকে দিয়েছে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে। অথচ যাঁরা বহিষ্কার হয়েছিল, তাঁরা বর্তমানে নাকি বুয়েটের হলে থাকছেন।
উল্লিখিত ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে বুয়েটের গত ছয় দশকে তিলে তিলে গড়ে তোলা একাডেমিক ও প্রশাসনিক নিয়মনীতি, বিশেষ করে পরীক্ষা ও নিয়োগ-পদ্ধতির প্রশ্নাতীত স্বচ্ছতা ও অর্জন আজ হুমকির মুখে। প্রাথমিক অবস্থায় শিক্ষকেরা শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এগুলো শুধরে নেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেছেন এবং সময় দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে বুয়েট রক্ষার সর্বশেষ পন্থা হিসেবে বর্তমান উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ এবং উপ-উপাচার্যের পদ বিলুপ্তির দাবিতে শিক্ষকেরা কর্মবিরতিতে গেছেন।
কিন্তু বুয়েট রক্ষার নির্দলীয় আন্দোলনকে একটি রাজনৈতিক রং দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষকেরা আন্দোলনে নামার পর শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের সব সদস্যকে এবং যাঁরা সাধারণ সভায় কথা বলেন, তাঁদের ফোনে হুমকি দেওয়াসহ সদস্যদের নামে মিথ্যা প্রচারণা এবং পোস্টারিং শুরু হয়েছে। শিক্ষকদের ফোনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার, এমনকি ‘সরিয়ে’ দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। অথচ এই কর্মবিরতি তথা আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া প্রশাসনিক প্রলোভন বা হুমকি তো আছেই। তাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি এই লেখায় নিজের নাম প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছি না বলে ক্ষমা করবেন।
বর্তমান উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের কার্যকলাপ সাধারণ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবক তথা দেশবাসীর কাছে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিকে অযাচিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, দয়া করে বুয়েট রক্ষার্থে আশু পদক্ষেপ নিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বুয়েটের একজন শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.