অগ্রগতির গতি হারাচ্ছে 'এশিয়ান টাইগার'! by আরিফুজ্জামান তুহিন ও রাজীব আহমেদ

বিশ্বমন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ও প্রত্যাশারও বেশি হারে রপ্তানি বৃদ্ধি চমকে দিয়েছিল বিশ্বকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আসা বিদেশিদের মুখে ছিল এ বিস্ময়ের কথা। বাংলাদেশকে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, আগামীর অর্থনীতির শক্তি হিসেবেই এখন দেখা হচ্ছে।


বাংলাদেশের সম্ভাবনা জেগেছে চীনের পাশাপাশি এমন একটি দেশ হয়ে ওঠার, যেখানে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি হবে। বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ৩০তম বড় অর্থনীতির দেশ।
এসব কথা কোনো রূপকথার গল্প নয়, অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাই বলছে এই সম্ভাবনার কথা। জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) এক জরিপে বিনিয়োগ-সম্ভাবনার দেশ হিসেবে ২০০৯ সালের ২৮তম অবস্থান থেকে ১৩ ধাপ এগিয়ে ১৫তম অবস্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি এগিয়ে রাখছে। বাংলাদেশের পোশাক খাত আরো এগিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ম্যাককেনসি। তাদের মতে, আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি দ্বিগুণ হবে। দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস ও মুডিস-এর ঋণমানে পর পর দুই বছর স্থিতিশীল অবস্থান দিয়েছে বাংলাদেশকে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান সিটি ব্যাংকের ২০১২ সালের ওয়েলথ রিপোর্টে ২০১০ থেকে শুরু করে ২০৫০ সাল পর্যন্ত যে কয়টি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার তালিকায় ৪ নম্বরে আছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাবি্লউ মজিনা বাংলাদেশকে বলেছেন আগামীর 'এশিয়ান টাইগার'।
কিন্তু সেই এশিয়ান টাইগার এখন যেন পেছন দিকে হাঁটছে। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে। দিনের পর দিন হরতাল, রাজনৈতিক নেতা নিখোঁজ হওয়া, দুই প্রধান দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের খবর মুহূর্তের মধ্যে বিদেশিরা জানছেন ইন্টারনেটের কল্যাণে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ইমেজ যতটুকু উন্নত হয়েছিল, ততটুকু আবার খারাপ হয়ে যাবে। রপ্তানিকারক দেশের বদলে বাংলাদেশ পরিচিত হবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দেশ হিসেবে। আর তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৩০তম বড় অর্থনৈতিক দেশ হওয়ার স্বপ্নটি কল্পনাতেই থেকে যাবে।
শুধু ব্যবসায়ীরা নন, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষসহ বিশিষ্টজনরা। সবার একটাই প্রশ্ন_ দেশ কোন দিকে যাচ্ছে? গত সপ্তাহে পর পর তিন দিন হরতাল ছিল। এ সপ্তাহে আবার দুই দিনের হরতাল ডাকা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান মাসে আট দিন ও ব্যবসা বাণিজ্য ছয় দিন বন্ধ থাকে। চলতি মাসে পহেলা বৈশাখ ও আসছে মাসের প্রথম দিন মে দিবস_সব মিলিয়ে মাসের অর্ধেক দিন কোনো কাজই হচ্ছে না। অর্থনীতি পড়েছে চাপে।
১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিএনপি আন্দোলনের ডাক দেয়। গত ২২ থেকে ২৪ এপ্রিল পর পর তিনদিন হরতাল পালিত হয়। আজ ও আগামীকাল আবার হরতালের ঘোষণা দিয়েছে দলটি। বিরোধী দলের এমন ঘনঘন হরতাল অর্থনীতিকে আরো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
হরতালে দেশের ভাবমূর্তির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে রাজনীতিবিদদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে_তাঁরা অর্থনীতির স্বার্থে হরতাল পরিহার করে বিকল্প কোনো কর্মসূচি দেবেন কি না। তবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ছোট-বড় সব দলকে একত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নইলে তা টেকসই হবে না।'
হরতাল সম্পর্কে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম গতকাল বলেন, 'আমরা ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে। একের পর এক হরতালে অর্থনীতির বারোটা বেজে যাচ্ছে।' তিনি বলেন, 'দেশের তৈরিপোশাক শিল্পের জন্য আমাদের সামনে বিশাল সম্ভাবনা খুলে গেছে চীনের শ্রম বাজারে শ্রমিকের পারিশ্রমিক বেড়ে যাওয়ার কারণে। আশা করা হচ্ছিল, আগামী অর্থ বছরে শুধু তৈরিপোশাক খাত থেকে ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করবে বাংলাদেশ। কিন্তু তার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা থাকতে হবে। যদি এমন জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ অব্যাহত থাকে, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে এই বিনিয়োগ চলে যাবে।'
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হরতাল এখন আর সাধারণ মানুষ পালন করে না। হরতালের আগে জ্বালাও-পোড়াও ও গাড়ি ভাঙচুর করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে হরতাল পালনে বাধ্য করা হয়। এই সংস্কৃতি থেকে গত দুই দশকে বের হয়ে আসতে পারেনি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। অর্থনীতির প্রয়োজনে রাজনীতি গড়ে ওঠে। এ কারণে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। তবে বাংলাদেশে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে অর্থনীতিকে।
তিনি বলেন, 'সবখানে অর্থনীতি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশে হচ্ছে এর উল্টোটা। এখানে রাজনীতি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণে রাজনীতিবিদরা অর্থনীতি বিকাশের বিরোধিতা করে হরতাল দিচ্ছেন।'
হরতালের বিকল্প কী : গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দাবি পূরণের সর্বোচ্চ কর্মসূচির একটি হলো হরতাল। তবে বাংলাদেশে এই কর্মসূচির এত ব্যবহার হয়েছে যে, হরতাল শব্দটির তাৎপর্য হারিয়ে গেছে বহু আগে। কোনো দল সরকারে থাকলে হরতালের বিরোধিতা করে। আবার বিরোধী দলে গেলে একই দল হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে প্রচার করে। মোট কথা হরতাল হচ্ছেই। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, হরতাল এখন আর নাগরিক অধিকার নয়।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করেন না। ফলে দেশ রসাতলে গেলো না কী_এটা নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই। তাঁরা আছেন ক্ষমতায় যাওয়া যায় কিভাবে, সে চিন্তা নিয়ে। ক্ষমতায় যেতে দেশ ধ্বংস হয়ে গেলেও তাতে রাজনীতিবিদদের কিছু যায় আসে না।'
সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার গতকাল বলেন, 'বাংলাদেশে যেভাবে হরতাল হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। কারণ, এখানে গাড়ি পুড়িয়ে, সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের মাধ্যমে, জানমালের ক্ষতি করে হরতাল পালন করা হয়। যদি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করত, তাহলে ভিন্ন বিষয় ছিল।'
বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্যের সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, 'জনগণ এখনো বিকল্প রাজনীতির কথা ভাবছে না। এ কারণে সরকার পক্ষ নির্যাতন করে আর বিরোধীরা দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হরতাল ডাকে। এই দুই গোষ্ঠীর পেছনে কিন্তু জনগণ রয়েছে। জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেনি। হরতালের কারণে এখন অনেকে ছুটিতে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। এই হরতালকে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যাখ্যান করার রাজনীতি কিন্তু করছে না জনগণ। এ কারণে তারা এসব ধ্বংসাত্মক রাজনীতি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেনি।' তিনি আরো বলেন, 'এ দেশের বিরোধী দল তাদের দাবি পূরণে হরতালের বিকল্প কোনো কর্মসূচির কথা জানে না। সরকারি দল মনে করছে_তাদের সঙ্গে পুলিশ আছে, আর বিরোধী দল গাড়ি ভাঙছে।'
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'রাজনীনিতিবিদের দেশের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে। একটি ঐকমত্যের জায়গায় আসতে হবে। আর যদি নাগরিক সমাজের উত্থান ঘটে, বিকল্প রাজনীতি এখানে দাঁড়ায়_তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।'
ড. ইমতিয়াজ বলেন, 'একটি সহনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি না হলে কোনো আলাপ হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমস্যার সমাধানের পথ বের করতে হবে। এ জন্য তাদেরকে সময় দিতে হবে। রাজনীতিবিদরা সমস্যার সমাধানের পেছনে সময় না দিয়ে আছেন ক্ষমতা থেকে কিভাবে সুবিধা নেওয়া যায়, তার পেছনে। রাজনীতিবিদের দেশের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে। একটি ঐকমত্যের জায়গায় আসতে হবে।' যদি নাগরিক সমাজের উত্থান ঘটে, বিকল্প রাজনীতি দাঁড়ায়_তাহলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে বলে হুশিয়ারি দেন ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'হরতালের পেছনের কারণগুলো সমাধানের পথ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন। হরতাল হলো তার উপসর্গ মাত্র।'

No comments

Powered by Blogger.