বাফুফের নির্বাচনী রঙ্গ

আগামীকাল বাফুফের নির্বাচন। ২১টি পদে প্রার্থী ৫২ জন। এক ঝাঁক সাবেক ফুটবলার-সংগঠকের সঙ্গে আছেন রাজনৈতিক নেতা, মেয়র, পুলিশ কর্মকর্তাও। যাঁর ইচ্ছে, এসেই প্রার্থী হয়ে গেছেন! লিখেছেন মাসুদ আলম
অতঃপর রহিমের প্রস্থান কাজী সালাউদ্দিন সভাপতি পদে খালি মাঠ পাচ্ছেন! এই যখন জল্পনা, দৃশ্যপটে হঠাৎ হাজির আবদুর রহিম।


বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তী সময়ে সহসভাপতি। বেশ কয়েক মাস ধরে ঢাকার রাস্তায় তাঁর ব্যানার-পোস্টার চোখ কাড়ছিল। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেছে। তাই বাফুফের নির্বাচনে অকস্মাৎ রহিমের আগমন এবং সভাপতি পদে প্রার্থিতা পেশ।
প্রচার আছে, সালাউদ্দিন যাঁদের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করেছেন, তাঁদের অনেকেই রহিমকে দাঁড় করিয়েছেন সভাপতি পদে। অর্থাৎ সালাউদ্দিনকে ‘ওয়াকওভার’ না দেওয়ার শেষ অস্ত্র হয়ে আসেন রহিম। জাকারিয়া পিন্টু সভাপতি পদে দাঁড়ালেও পরে প্রত্যাহার করেছেন। রহিমও শেষ পর্যন্ত সালাউদ্দিনকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনী মাঠ ছেড়ে গেছেন। সালাউদ্দিন-বিরোধীদের মুখটা কালো হয়ে গেল—এমন হাস্যরস শোনা যাচ্ছে অনেকের মুখেই।

গোড়াতেই গলদ
সালাউদ্দিন-বাদল রায়-হারুনুর রশিদরা সম্মিলিত ঐক্য পরিষদ নামে একটা পরিষদ করেছেন। যদিও অনেকে বলেন, এর ভেতরেই আছে আরেকটি পরিষদ! মানে একের ভেতর দুই। বলা হচ্ছে, ওপর দিয়ে এই পরিষদ এক হলেও ভেতরে ভেভরে তাঁরা বিভক্ত। সালাউদ্দিনকে সভাপতি পদে চান না এমন লোক এই পরিষদে আছেন। কিন্তু ওপর দিয়ে ঐক্যের গান গেয়ে চাইছেন নিজেরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে। বাইরে এমনও শোনা যায়, সালাউদ্দিন নয়, রহিমের জন্য ভোট চাওয়া হয়েছে এই পরিষদের ভেতর থেকে! কিন্তু রহিম সরে দাঁড়ানোয় সালাউদ্দিন এক অর্থে নির্বাচিত হয়েই গেছেন। তাঁর বিরোধীরাই উল্টো ফাঁপরে পড়েছেন। এরই নাম নির্বাচন!

বিমানে ভ্রমণবিলাস
চার বছরে ঢাকার বাইরের ফুটবলের তেমন খোঁজ রাখেনি বাফুফের বর্তমান কমিটি। কিন্তু আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে ঢাকার বাইরের ভোট তাঁদের বড় সহায়। ভোট পেতে সদলবলে সালাউদ্দিন-বাদল রায়রা বিমানভ্রমণে বেরিয়েছেন। প্রথমে গেছেন খুলনা, ওই অঞ্চলের ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনা করে এসেছেন। তারপর গেছেন চট্টগ্রাম। ২১ সদস্যের পরিষদের প্রায় সবাই ছিলেন এই কাফেলায়। হায় রে, ভোটের আগে যদি এভাবে অন্তত একটা দিন ঢাকার বাইরে তাঁরা যেতেন!
শুধু তা-ই নয়, ঢাকার ক্লাবপাড়ায়ও গত চার বছরে কেউ যাননি। এখন ভোটের বাজারে সেই ঢাকার ক্লাবগুলোতেও ঘুরে ঘুরে ভোট চেয়েছেন। প্রার্থীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ, এবার সভাপতি পদ বাদে বাকি ২০ পদে হবে তীব্র লড়াই। সালাউদ্দিন-বাদল রায়দের পরিষদে অনেক বড় বড় প্রার্থী ঝুঁকির মধ্যে আছেন।

বদলের ডাক
যেকোনো নির্বাচনে পরিবর্তন শব্দটা বেশ টানে সবাইকে। এবার সেই আলামত দেখা যাচ্ছে। ‘ফুটবল বাঁচাও’ পরিষদ করে আরিফ খান জয়দের মতো তরুণেরা ডাক দিয়েছেন দিন বদলের। তাতে যোগ দিয়েছেন শফিকুল ইসলাম, মহিউদ্দিন মহি, আমিরুল ইসলাম, তাবিদ আউয়ালসহ অনেকে। আছেন গোলাম রাব্বানি হেলাল। গত কমিটির অনেক দুর্বল দিক ছিল, সেটিকে কাজে লাগিয়ে এই পরিষদ ভোটারদের কাছাকাছি যাচ্ছে এবং বেশ কয়েকটা পদে জিতে গেলেও অবাক হওয়ার থাকবে না। এ কারণেই বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনী মাঠে অতি সতর্ক। সবারই কপালে চিন্তার ভাঁজ।

সহসভাপতি পদে জমবে লড়াই
সহসভাপতি পদেই সবচেয়ে বেশি জমছে নির্বাচন। সিনিয়র সহসভাপতি পদে প্রার্থী পাঁচজন, সহসভাপতি পদে ৯ জন! সিনিয়র সহসভাপতি পদে বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদী, বর্তমান সদস্য গোলাম রাব্বানি হেলাল, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, নুরুল আলম চৌধুরী ও মোস্তাকুর রহমান। চারটি সহসভাপতি পদে বর্তমান চার সহসভাপতি মনজুর হোসেন, বাদল রায়, শওকত আলী খান ও কাজী নাবিল আহমেদ। তাঁরা সম্মিলিত ঐক্য পরিষদের প্রার্থী। ‘ফুটবল বাঁচাও’ পরিষদের প্রার্থী আরিফ খান জয়, মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, তাবিদ আউয়াল। এ ছাড়া আছেন রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির, খোরশেদ বাবুল।
প্রার্থীরা সবাই জেতার ব্যাপারে আশাবাদী। অনেকের চোখে-মুখেই ‘৩০ তারিখ দেখিয়ে দেব’ আত্মবিশ্বাস ফুটে বেরোয়। তবে ভেতরে ভেতরে কিন্তু স্নায়ুচাপে কাবু সবাই। কারও কারও পক্ষে রাজনৈতিক চেষ্টা-তদবির চলছে। টাকার খেলাও চলছে বলে শোনা যায়। নির্বাচনে কোটি টাকা খরচ করার প্রার্থী নেহাত কম নয়!

দুই মেয়র
তাঁরা দুজন পৌরসভার মেয়র। রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র সাইফুল ইসলাম ভুট্টো সদস্যপদে লড়ছেন ‘ফুটবল বাঁচাও’ পরিষদ থেকে। মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র ইয়াদ আলী মনোনয়নপত্র তুলেও পরে প্রত্যাহার করেছেন। দুজনই স্থানীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কালেভদ্রে তাঁদের দর্শন মেলে না বাফুফে ভবনে। তবে এখন ফুটবলের নির্বাচনী হাওয়া দুজনকে টেনে এনেছে বাফুফে ভবনে। নির্বাচন বলে কথা!

আছেন পুলিশ কর্মকর্তাও
এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের নিরাপত্তা কমিটির সদস্য তিনি। শেখ মারুফ হাসানের বড় পরিচয় ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার, গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। সালাউদ্দিন-বাদল রায়দের পরিষদে সদস্য প্রার্থী।

এবং গাফফার
বেশ কিছুদিন ধরেই ফুটবলে যাতায়াত বাড়িয়েছেন আবদুল গাফফার। আমেরিকা প্রবাসী সাবেক এই ফুটবলার সালাউদ্দিনদের পরিষদের সদস্যপদে জায়গা পেয়েছেন। গাফফার শেখ জামাল ক্লাবের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। স্ত্রী, সন্তানেরা আমেরিকায়। কিন্তু গাফফার ঢাকায়। নির্বাচিত হয়ে ফুটবল উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক এই কমিশনার।

চমকের নাম তাবিদ
বিদেশে পড়াশোনা, ধনাঢ্য বাবার ব্যবসা সামলান। ফেনী সকার দলে খেলেন, আবার দলটির পৃষ্ঠপোষকও। হতে চান বাফুফের সহসভাপতি। সহসভাপতি প্রার্থী হয়ে ফুটবল বাঁচাও পরিষদে যোগ দিয়েছেন আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তরুণ তাবিদ আউয়াল।

দুজন দুই কূলে
সালাউদ্দিনের সঙ্গে গোলাম রাব্বানি হেলালের ঘনিষ্ঠতা ফুটবলে সবারই জানা। দুজনের সেই প্রেম ভেঙে গেছে। বিদায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে হেলাল একটা সময় পর্যন্ত সক্রিয় থাকলেও পরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। সালাউদ্দিনের সঙ্গে বাড়ে দূরত্ব। এত দিন ক্রীড়াঙ্গনে রব্বানি হেলাল যেভাবেই উপস্থাপিত হন না কেন, ভোটের মাঠে বিচরণ করছেন দাপট নিয়ে। তবে আসল দৌড়টা বোঝা যাবে ভোটের বাক্সে।

পাদটীকা: নির্বাচনে প্রার্থী হতে কাউন্সিলর হওয়া লাগবে না—হঠাৎ এই নিয়ম আবিষ্কারের ফল প্রার্থী জোয়ার। তাতে আর ঘরে বসে থাকবেন কেন শফিকুল ইসলাম মানিকরা। মুক্তিযোদ্ধার কোচ শফিকুল সদস্যপদে প্রার্থী হয়ে গেলেন শেষ মুহূর্তে। কোচ ও সংগঠক দুটি পরিচয়ই আপাতত মিলেমিশে একাকার!
সে যাহোক, গত কমিটির মতো শক্তিশালী কমিটি বাফুফেতে সম্ভবত আর হবে না। এবার প্রার্থী জোয়ারের নির্বাচনে পাঁচমিশালি একটা কমিটি হতে পারে। আসতে পারে অনেক নতুন মুখ। তাই পুরোনোরা রীতিমতো কাঁপছেন!

No comments

Powered by Blogger.