চারদিক-জুরাইনের পাগলপ্রাণ ছেলেমেয়েরা by ফারুক ওয়াসিফ

বক্তা থতমত, অধ্যাপক বিব্রত; বাচ্চাকাচ্চার দল মহা খুশি। মঞ্চের লোকদের তারা আচ্ছা ফাঁপরেই ফেলেছে। তাদের কিচিরমিচির আর ফিচেল হাসির ধারকে ভয় না পেয়ে উপায় কী! শিশুবাহিনীর ভাবটা এমন: বলো দেখি, শোনাও দেখি, বোঝাও দেখি কেমন পারো! এমনই সহজ আনন্দের কাহিনিতে ভরে গেল জুরাইন বইমেলার একটা বিকেল।

মনে হলো, পাগলের সুখ সত্যিই মনে মনে। যাঁর মন আছে এবং যিনি যৎসামান্য পাগল, সেই সুখে তিনিও ভজে যেতে পারেন।
গ্রাম দেশে পাগল আদরের ডাক। সেই পাগলও আবার দুই প্রকার: ভাবের পাগল আর কাজের পাগল। জুরাইনের পাগলপ্রাণ ছেলেমেয়েরা দুই দিকেই সেরা। এই পাগলরা বিচিত্র সব কাণ্ড করে আসছে। কখনো দেখা যায়, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ময়লা নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসছে। এই তারা করছে মাদকবিরোধী আন্দোলন, এই বসাচ্ছে রক্তদানের ক্যাম্প, বন্যা আর শীতে ত্রাণ নিয়ে ট্রাকে চড়ে বসা তো প্রতিবছরের কাজ।
১৯৯৮ সাল থেকে তারা বসাচ্ছে বইমেলা। এ নিয়ে সপ্তমবারের মতো সেই মেলা বসল: ১৫ থেকে ১৭ মার্চ। আগে হতো রাস্তার পাশে, গলির ভেতর, নর্দমার ওপর কাঠ ফেলে। এবার দেখলাম, তিনতলা সমান উঁচু বিরাট এক হলঘরে মেলা বসেছে। সেটা নাকি একটা হবু সিএনজি কারখানা; মেলা বসেছে তার ভেতরই। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি বইয়ের দোকান, নামী প্রকাশনীরাও বাদ নেই। এলাকায় খবর রটে গেছে। সন্ধ্যা হতেই মায়েরা, মেয়েরা, বাবা-ভাই-কাকারা আসছে, দোকানে দোকানে ঘুরছে। ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চের আলোচনা বা নাচ-গানের দিকেও ফিরছে। জমে উঠছে আনন্দ কোলাহল।
গত শুক্রবারের দিনে সেখানে অসংখ্য শিশুর সভা বসে। তাদের পাল্লায় পড়ে জেরবার দুই বক্তা। ক্লাসরুমে বা বাড়িতে শিশুদের কান ঝালাপালা করা ওয়াজ-নসিহত তো কম করা হয় না। কিন্তু এটা বিদ্যালয় বা বাড়ি নয়। এটা মেলা, শিশুরা এখানে নির্ভয়। কথা ভালো না লাগলে হইচই করে সব পণ্ড করে যে দেবে না, তার গ্যারান্টি কী? গ্যারান্টি নেই, তার পরও অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী বয়সোচিত প্রজ্ঞায় হাল ধরলেন এবং মন জয় করলেন।
যা হোক, গল্পে আর মনমজানো কথায় তাদের ধরে রাখা গেল। এবার আসবে তারা পুরস্কার নিতে। মনে পড়ে, এ রকম করেই তো, ষষ্ঠ শ্রেণীর পুরস্কার নিতে গিয়েছিলাম। পেয়েছিলাম হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের কুচ্ছিত হাসের ছানা আর মার্ক টোয়াইনের হাকলবেরি ফিন। বই দুটির সুবাদে আমার মনের লকপক করা কল্পনালতা এমনই আনচান করে ওঠে যে শুরু করি হাবিজাবি কল্পগাথা।
আজ সেদিনের সেই শিশু, আমাদের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে এ দিনের শিশুরা। লাল ফিতায় বাঁধা বই উপহার দিচ্ছি বটে কিন্তু অতিথিসুলভ গাম্ভীর্য আরও কঠিন হচ্ছে। আহা! প্যাকেটের ভেতরে কী বই, তা যদি জানতাম! কিংবা পারতাম, ওদের মতো করে দুরু দুরু বুকে গল্প-কবিতা-গান গেয়ে বা লিখে পুরস্কার নিতে! সেই সব রোমাঞ্চ যদি আবার ধরা দিত প্রাণে!
জুরাইনের সেই বিকেল অনেক ভাবাল। ঢাকার হট্টগোল, নোংরা-গদগদে সড়ক আর গিজগিজে ভিড় ফুঁড়ে জেগে উঠছে এক দুস্থ লোকালয়। আজ যেখানে বইমেলা, কদিন আগেই সেখানটা ডুবে ছিল কুচকুচে কালো দুর্গন্ধময় পানিতে। নর্দমা খেয়ে ফেলছিল সড়কটিকে। আজ সেই জায়গাটা শুকনো, অচল রাস্তাটা নতুন করে বানানো হচ্ছে। জুরাইনে তরুণেরা সাংসদ ও প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও যখন কিছুই পেল না, তখন তারা নিজেরাই নেমে পড়ল। সেই দৃশ্য পয়লা ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোয়ও ছাপা হয়েছে। সরকার-রাষ্ট্র যেখানে উদাসীন, সেখানে সমাজ দায়িত্ব নিয়েছে। এই কাজের নাম তারা দিয়েছে, ‘পূর্ব জুরাইন পয়োনিষ্কাশন কার্যক্রম ২০১২, উদ্যোগে তরুণ সমাজ, সহযোগিতায় সর্বস্তরের জনগণ’। কথাগুলো শতভাগ সত্যি, উদ্যোগটা সমাজের তরুণদেরই, সহযোগিতায় সর্বস্তরের জনগণই বটে। পুরো দৃশ্যে সিটি করপোরেশন নেই, সাংসদ নেই, ওয়াসা-ডেসা প্রভৃতি নেই। একেবারে নেই বলা যাবে না, ইমেজ বাঁচাতে রাস্তাঘাট আবর্জনামুক্ত হওয়ার পর তাঁরা এসেছেন। বহু প্রতীক্ষিত সড়ক নির্মাণও শুরু হয়েছে। একেই বলে ঠেলার নাম বাবাজি। জুরাইনের তরুণ বাবাজিদের ধন্যবাদ। তারাই তো শনির আখড়ার সঙ্গে মিলে একসময় পানির দাবিতে আন্দোলন করেছিল।
কবি মাসুদ খানের বিখ্যাত কুড়িগ্রাম কবিতায় কুড়িগ্রামকে রাত হলে মাটি ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে যেতে দেখি। তেমনি পাগলদের ফেঁড়ে পড়ে জুরাইন ঢাকাই খাসলত ঝেড়ে ফেলে উঠে আসে। দিনদুপুরে, সবার সামনে। সরকারের খাতায় আর থানার চোখে যে জুরাইন অবাধ্য, বিশৃঙ্খল আর ঘিঞ্জি, ক্ষমতার চিপা খুলে সেখানে এখন সমাজ নড়েচড়ে উঠছে। এক দঙ্গল তরুণ যে যা পারে, যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে নিজেদের মহল্লাটাকে বদলে দিচ্ছে, শ্বাস ফেলছে বড় দল আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ের ওপর। বধির প্রশাসন আর দাপুটে মানুষেরা যতই ফন্দিফিকির করুক, জুরাইনের পাগলপ্রাণ ছেলেমেয়েরা সবকিছুকে সুস্থ-সিধা করবে বলে পণ করেছে। এই পণ জীবনের পণ, সামাজিক মানুষের পণ। বাজারের চাপে, ক্ষমতার দাপটে যে সমাজ প্রায় নির্জীব, এই তরুণেরা সেই সমাজেরই চিকিৎসক।
ফারুক ওয়াসিফ

No comments

Powered by Blogger.