পাকিস্তান-রাষ্ট্রের ভেতরকার রাষ্ট্রের দাপট by কামরান শফি

আমার বয়স ৬৬ বছর। নিকটজনদের মৃত্যুতেও আমি কাঁদিনি। ছোট ভাইটি পাহাড়ে উঠতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেল ২১ বছর বয়সে। আমার প্রিয়তম দাদিমা; যিনি আমাকে বড় করেছেন, আমার ভালোবাসার খালা ও চাচা, বাবা-মা, এমনকি প্রিয় বন্ধুদেরও মৃত্যু হয়েছে। আমি কাঁদিনি। কিন্তু যেভাবে তরুণ সরফরাজ খানকে একেবারে গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা হলো, তা দেখে আমি কেঁদেছি।

তাকে ঘিরে থাকা লোকজনদের কাছে সে প্রাণভিক্ষা চাইছিল, তার সেই চিৎকার আমি কোনো দিন ভুলব না। গুলি খাওয়ার পর সে তাদের বলছিল, ‘দয়া করুন, আল্লার দোহাই, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।’ সে তখন পড়ে থাকল মাটিতে, ব্যথায় কাতরাল এবং আবার উঠে বসে মিনতি করতে থাকল। সবটা সময় সে তাদের কাছে কাকুতিমিনতি করে যেতে থাকল...তারপর আবার শুয়ে পড়ল, গোঙাল এবং পরে মরে গেল।
সেখানে যারা ছিল, যে রেঞ্জারদের একজন তাকে গুলি করেছিল, সেখানে হাজির দর্শকেরা, কেউই তার মুখে শেষ পানিটুকু পর্যন্ত দিল না। কেউ সাহস করে তাকে তুলল না, নিয়ে গেল না কাছাকাছি হাসপাতালে। হয়তো তাহলে তার রক্ত পড়া বন্ধ করা যেত, হয়তো তাহলে হতভাগাটি বেঁচে যেত।
এ কী হলো আমাদের? কী ভয়ংকর আর কুৎসিত এক জাতিতে পরিণত হয়েছি আমরা? একবিন্দু মনুষ্যত্বও কি অবশিষ্ট নেই আমাদের? এটাই কি প্রথম নির্বিচার হত্যাকাণ্ড? বালুচিস্তানে নিয়মিতভাবে হত্যা চলছে। এসবের মধ্যে; বিশেষ করে, উল্লেখযোগ্য হলো বিপুল জনপ্রিয় ও উদারমনা অধ্যাপক সাবা দাশতিয়ারিকে হত্যা। দুই সপ্তাহ আগে মুখোশ পরা লোকেরা তাকে গুলি করে মেরে ফেলে।...সাংবাদিক সালিম শাহজাদকে হত্যা করা হয়...শিয়ালকোট পুলিশ নিয়মিতভাবে এনকাউন্টার চালিয়ে যাচ্ছে। কেন এখন এসব শুরু হলো? কেন পাকিস্তান এক বধ্যভূমিতে পরিণত হচ্ছে?
কী বলার আছে আমাদের নির্ভীক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর? স্বভাবজাত অননুকরণীয় ঢঙে তিনি ঘোষণা করলেন যে ছেলেটি চোর এবং ছিনতাইকারী। মনে করুন, যখন মার্কিন নাগরিক রেমন্ড ডেভিস দুজন সশস্ত্র পাকিস্তানিকে হত্যা করেছিলেন, তখন কিন্তু এ রকম অস্বীকারের ঘটনা ঘটেনি। সেই ঘটনা আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছিল।
কোনো ঘটনায় সাড়া দেব আর কোনো ঘটনা অস্বীকার করব, এমন কপটতা আমাদের মধ্যে প্রচুর। এমনকি আমার বন্ধু ইমরান খানও সরফরাজ শাহর বর্বর হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদ করতে নামলেন না। কারণ কি এই যে ওই দুই তরুণ একজন আমেরিকানের হাতে নিহত হয়েছিল আর সরফরাজ শাহকে হত্যা করেছে আমাদেরই নিরাপত্তা বাহিনী। ধিক আমাদের!
লাহোরের ওই দুই যুবকের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনেক টাকা দেওয়া হয়েছিল তাদের স্বজনদের। কিন্তু সরফরাজের দরিদ্র বাবা-মাকে কে দেবে ক্ষতিপূরণ? আমরা এও জানি, ক্ষতিপূরণ যদি কিছু দেওয়াও হয়, তা হবে অতি সামান্য।
এ বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর যে বিবৃতি আইএসপিআর দিয়েছে, তাকে মোবারকবাদ জানানোর কিছু নেই। তাদের মতামত ছিল খুবই রূঢ়। একজন সাবেক সেনাপ্রধান পত্রিকায় ইংরেজিতে কলাম লিখেছেন, শিগগিরই যার অনুবাদ উর্দু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে। তিনি লিখেছেন, ‘এই বিবৃতিকে ভুল বিবেচনা থেকে গ্রহণ করা ত্বরিত মন্তব্য বলে ভাবা ভুল হবে’। জেনারেল কারামাত আসলে বলতে চেয়েছেন, সেনাবাহিনীর তরফে ওই বিবৃতি উগ্র ও যুদ্ধংদেহী হলেও মনে করার কারণ নেই যে তারা কোনো সামরিক অভ্যুত্থান করতে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘কোনো মহল তাদের পক্ষপাতী অবস্থান থেকে সামরিক বাহিনীগুলো এবং বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত।’ তাঁর কাছে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা, ‘পক্ষপাতী অবস্থান’ মানে কী? কোনো মামুলি বিষয়ে কোনো নাগরিকের মতামত সেনাপ্রধানের মতের সঙ্গে না মেলার মানেই কি তিনি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে? এ রকম মনোভাব ত্যাগ করাই শ্রেয়।
তিনি আরও বলেছেন, ‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে বিভক্তি নিয়ে আসা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। ওই (সামরিক) সভার অংশগ্রহণকারীরা একমত হয়েছেন যে আমাদের সবারই এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা আমলে নেওয়া উচিত।’ নিশ্চয়ই আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বিধাবিভক্ত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা কি দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তানীতির বেলায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সব ক্ষেত্রে তাঁদের হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করবেন? আর তাঁরা যাঁকে অভিযুক্ত করছেন, তাঁকে টেনেহিঁচড়ে সামরিক আদালতের চটজলদি বিচারের মুখোমুখি করা ছাড়া আর কোনো আইনসম্মত উপায় কি তাদের জানা নেই?
সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি তখনই ভালো হবে যখন তারা সাধারণ মানুষকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। যখন আপনারা আমাদেরও দেশরক্ষার কাজের অংশীদার করবেন, যখন আপনারা বাণিজ্যিক কায়কারবার থেকে বিরত থাকবেন, যার কারণে সেনানিবাস দূষিত হয়েছে এবং সন্ত্রাসবাদীদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে, তখন অবস্থার পরিবর্তন হবে। তখন নওশেরার সেনা বেকারিতে হামলার মতো ঘটনাও আর ঘটবে না।
এটাও নজরে পড়ার মতো যে সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এজেন্সিগুলোর ওপর যথাশিগগির বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা বলায় বিরোধীদলীয় নেতা নওয়াজ শরিফকে আলাদা করে তিরস্কারের নিশানা করা হয়েছে। এটা করেছেন রাষ্ট্রের ভেতরকার রাষ্ট্রের (ডিপ স্টেট) সমর্থকেরা। তিনি যখন বলেন যে কাউকে ‘পবিত্র’ বলে ছাড় দেওয়া যেতে পারে না এবং রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে হবে, তখন তাঁকে অভিনন্দন জানাতেই হয়।
পাকিস্তানের ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ।
কামরান শফি: পাকিস্তানি সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.