জার্মানি-পারমাণবিক শক্তিভীতি ও পরিবেশ by মুশফিকুর রহমান

জার্মান সরকার এ বছরের ৩০ মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যে জার্মানিতে অবস্থিত ১৭টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেবে। জার্মানির পরিবেশবাদী সংগঠন ও গ্রুপগুলো স্পষ্টই এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট। জার্মান পার্লামেন্টের অনুমোদনের পর এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। তবে জার্মান পরিবেশমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন না বলে দাবি করেছেন।

চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পরও জার্মানিতে তীব্রভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার দাবি উঠেছিল। এক দশক আগে জার্মানির সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের বর্তমান সরকার গত বছর সে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে জার্মানির পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ব্যবহার গড়ে অতিরিক্ত ১২ বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে সময় চ্যান্সেলর মেরকেল দাবি করেছিলেন, পৃথিবীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সবচেয়ে দক্ষ ও পরিবেশসম্মত।
কিন্তু গত ১১ মার্চ জাপানের ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভূমিকম্প ও সুনামি আঘাত হানার পর জার্মানির রাস্তায় লাখো মানুষের মিছিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তোলে। জার্মান সরকারের গঠিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও নৈতিকতাবিষয়ক কমিশনের সুপারিশে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিশন কো-চেয়ারম্যান ম্যাথিয়াস ক্লাইনার বলেছেন, জাপানের মতো উচ্চ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ পর্যন্ত এমন দুর্ঘটনা সামাল দিতে পারছে না। পারমাণবিক প্রযুক্তি আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের জন্য অনেক ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ। এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেবল ইতালি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছে। জার্মানির জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র বন্ধ করা বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। ঘাটতি পূরণে জার্মানিকে জীবাশ্ম জ্বালানিসহ অন্যান্য উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে জার্মানি ইউরোপের সবচেয়ে বড় বৈদ্যুতিক শক্তির বাজারও বটে। জার্মানির নাগরিকেরা আমেরিকানদের চেয়ে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ কেনে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় ২৩ শতাংশ ঘাটতি পূরণে জার্মানিকে বর্ধিত আমদানি, অন্যান্য উৎসের সংস্থান এবং বাড়তি উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। অপরদিকে জার্মান শিল্পসংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত রাখা এবং বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। এ দিকে জার্মানির চ্যান্সেলর মেরকেল বলেছেন, ২০২০ সালের মধ্যে তাঁর দেশ বিদ্যমান প্রায় ১৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৩৫ শতাংশে উন্নীত করতে এবং কার্বন নিঃসরণ আরও হ্রাস করতে চায়। কিয়োটো প্রটোকল অনুযায়ী, জার্মানির ২০১২ সালের মধ্যে বছরে কার্বন নিঃসরণ ৯৭২ দশমিক ৯ মিলিয়ন টনে সীমিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইতিমধ্যে জার্মানি সে লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়েছে। তবে শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে জার্মানিকে কার্বন নিঃসরণ আরও কমানোর আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাবহার হ্রাস করা কার্বন নিঃসরণ কমানোর অন্যতম পূর্বশর্ত। সে বিবেচনায় পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুতের উৎপাদন অন্যতম কাঙ্ক্ষিত পন্থা। জার্মানির প্রতিবেশী পোল্যান্ড দুটি নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই পারমাণবিক বিদ্যুতের দূষণ ও কার্বন নিঃসরণ সীমিত রেখে জ্বালানি ও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের উপায় ভাবছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করা সম্ভব। তবে এখন পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি অন্য বিকল্পগুলোর চেয়ে ব্যয়বহুল। তাই জার্মানি একই সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার দ্বৈত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জার্মানি প্রধানত বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়ে ঘাটতি পূরণের কথা ভাবছে। একই সঙ্গে ২০২০ সাল নাগাদ ১০ শতাংশ বিদ্যুতের ব্যবহার হ্রাস করার পরিকল্পনার কথাও জার্মান সরকার বলছে। সংশয়ীরা মনে করেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য অর্জিত হবে না। তাই দ্রুত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করলে কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার জার্মানিতে বাড়বে। সেই সঙ্গে ফ্রান্স ও চেক প্রজাতন্ত্রে উৎপাদিত পারমাণবিক বিদ্যুতের আমদানির ওপর জার্মানির নির্ভরতা বাড়বে।
মানুষ সাধারণভাবে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ সস্তায় পেতে চায়। জার্মান সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত তার ইউরোপীয় প্রতিবেশী দেশগুলো আহ্লাদিত হয়ে গ্রহণ করেনি। পারমাণবিক বিদ্যুতের ওপর প্রায় ৮০ শতাংশ নির্ভরশীল ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অন্তত কিছু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য দূষণ নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্য কোনো উপায় নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফ্রান্স এককভাবে এক-তৃতীয়াংশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করে। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টই বলেছেন, তাঁর দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতি থেকে সরে আসবে না। সুইডেনের পরিবেশমন্ত্রী জার্মান সরকারের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সময়সীমা ঘোষণার সমালোচনা করেছেন এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ইউরোপের দেশগুলোতে এ কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। পারমাণবিক বিদ্যুতের ওপর ৪০ শতাংশ নির্ভরশীল সুইজারল্যান্ড পর্যায়ক্রমে বিদ্যমান পারমাণবিক চুল্লিগুলোর জীবনকাল ৫০ বছর পূর্ণ হলে সেগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ফেডারেশন অব জার্মান ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট হান্স-পিটার কাইটেল দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগ্রলো ২০২২ সালের ভেতর বন্ধ করার সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার বিরোধিতা করেছেন। জার্মান শিল্প কর্মকর্তারা অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণার উদ্যোগকে রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের বিবেচনায়, এ সিদ্ধান্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ঘটাবে এবং জার্মানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস করবে। গত এক দশকে জার্মানিতে বিদ্যুতের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য বিপুল ভর্তুকি অনেকাংশে দায়ী। অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের নিজ দলের অর্থনৈতিক কাউন্সিলও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। কমিশনের চেয়ারম্যান কুর্ট লাউক সম্ভবত সঠিক পর্যবেক্ষণ করেছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা নিয়ে যত শুনছি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারের ব্যয় নিয়ে আলোচনা সে তুলনায় সামান্যই শুনছি।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.