চারদিক-এই ভোট সেই ভোট by আকমল হোসেন

ভোট শুনলেই একটা উৎসবের মেজাজ চলে আসে বাঙালির আঙিনায়। উৎসব মানে তো আনন্দ-হইচই হবে, মজা হবে। জীবনজুড়েই উৎসব থাকার কথা। যদিও নানা জটিলতার কারণে অনেকের জীবনেই উৎসবের স্বাদটা মেলে না। কিন্তু ভোট মনে হয় এর ব্যতিক্রম।

একদম বড়লোক থেকে একেবারে অন্ত্যজ, তুচ্ছ মানুষটির কাছেও ভোট নতুন আলোড়ন হয়ে আসে। তখন প্রায় সবাই ভুল-শুদ্ধ যা-ই হোক, নিজের মতো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায়।
এই যে সহজ করে ভোটের কথাটা বলা গেল, বাস্তবে তো আর পরিবেশটা এমন হয় না। ভোটের সঙ্গে সংঘাত, দলাদলির নামে হিংসা-প্রতিহিংসা কেমন যেন জড়িয়ে গেছে। পরিবেশ হয়ে ওঠে হিংস্র, রক্ত ঝরানো। যেনতেনভাবে ক্ষমতাটাকে চাই। এর জন্য বোমা ফাটে, গুলি ফোটে। কখনো কখনো প্রাণ বলিদানের ঘটনা ঘটে। তাই ভোটের সঙ্গে সারাক্ষণ আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা প্রায় মাখামাখি হয়ে থাকে।
কিন্তু এই প্রচলিত ধারণার বাইরেও বোধ হয় ভোট করা যায়। ভোটও যে একটা উৎসব—অন্তত একদল শিশু সেটা বুঝিয়ে দিল। দ্বন্দ্ব-সংঘাত নয়, পরস্পরের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক, চমৎকার বোঝাপড়ার মধ্যেও ভোট হতে পারে।
গত শনিবার (১১ জুন) মৌলভীবাজার বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচন ছিল। ভোররাত থেকেই বৃষ্টি। তাতে কি, ভোটাররা স্কুলের পোশাক পরে ভোট শুরুর সময় নয়টা বাজার আগেই হাজির। দেখা গেল, বিদ্যালয়ের সামনে শান্ত পরিবেশ। স্কুলে ঢোকার ফটকে স্বেচ্ছাসেবক দল (স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্র) তৎপর। যারা ভোটার নয়, তাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৩০০ ভোটার। একদম কড়া নিরাপত্তা। কোনো পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার কেউ নেই। নেই অকারণ হইচই। বৃষ্টিতে বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মাঠটি কর্দমাক্ত। তাই বারান্দায় দুই সারিতে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ভোটাররা। একজনের পর একজন করে ভোটকেন্দ্রে ঢুকছে। ভোটকক্ষে তখন খুবই কর্মব্যস্ত সময় যাচ্ছে প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের। ভোটার সামনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভোটার তালিকায় সবাই হুমড়ি খেয়ে নাম দেখছে। তারপর ব্যালট পেপার দেওয়া হচ্ছে। ভোটার পর্দার আড়াল দেওয়া স্থানে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্দিষ্ট বাক্সে এনে ফেলে বাইরে চলে যাচ্ছে।
এখানেও পক্ষ-বিপক্ষ আছে, পছন্দ-অপছন্দ আছে, প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। এখানে সাতটি পদের জন্য প্রার্থী হয়েছিল ১৮ জন। বোঝাই যায়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা খুব জমজমাট। কিন্তু কোথাও একফোঁটা বিশৃঙ্খলা নেই। কারও বিরুদ্ধে কারও কুৎসা রটনা নেই। মিথ্যা আশ্বাসের ফুলঝুরি নেই। ভোটার, প্রার্থী সবাই পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, হাসিখুশি। দারুণ একটা উৎসবের মেজাজ।
বিদ্যালয়ে শিখন শেখানো কার্যক্রম এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, বিদ্যালয়ে শতভাগ ছাত্র ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধে সহযোগিতা, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন, শিখন শেখানো কার্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা সম্পর্কে অভিভাবক ও অন্যদের অবহিত, উদ্বুদ্ধকরণ এবং শিশুকাল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করার জন্য এই স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচন।
জানা গেল, প্রত্যেক প্রার্থীই কেন প্রার্থী হয়েছে, জিতলে কী করবে তা বলেছে ভোটারদের কাছে। এ রকমই একজন প্রার্থী পঞ্চম শ্রেণীর একা রাণী রায় ভোটারদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা জানায়, ‘ছাত্রছাত্রীরা যাতে স্কুলে আসে, তার খোঁজ নেব। স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখব।’ আরেক প্রার্থী হোমায়রা হোসেন তিথি বলল, ‘আমি বলেছি, আমাকে আপনাদের ভালো লাগলে ভোট দেবেন। না হলে না।’ তিথি আরও বলল, ‘হেরে গেলে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানাব।’ ভোটার চতুর্থ শ্রেণীর উর্মি আক্তার সীমা বলে, ‘সবাই এসে ভোট চাইছে। বলছে ভোট দিয়ে সহযোগিতা করতে।’ আরেক ভোটার তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র রুবেল মিয়া বলে, ‘লাইন ধরে ভোট দিচ্ছি। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই।’
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা পঞ্চম শ্রেণীর মোহাম্মদ রনি সহকর্মীদের নিয়ে খুব ব্যস্ত। হেসে বলল, ‘জীবনের প্রথম দায়িত্ব পালন করছি তো, খুব আনন্দ বোধ করছি।’ তার সঙ্গে কাজ করছে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে পঞ্চম শ্রেণীর মুনতারামা জিনিয়া; পোলিং কর্মকর্তা পঞ্চম শ্রেণীর রফিকুল আলম, চতুর্থ শ্রেণীর প্রাপ্তি চক্রবর্তী ও তৃতীয় শ্রেণীর সমাপ্তি রিচি।
দুপুর একটায় ভোট শেষে ফল ঘোষণা হলো। বিজয়ীদের অভিনন্দন জানায় পরাজিতরা। যারা হেরে গেল, তাদের তো কিছুটা মন খারাপ হলোই। কিন্তু কোনো প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসামূলক আচরণ হলো না কোথাও। সহজেই ফল মেনে নিল সবাই।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল বাছিত বললেন, ‘নির্বাচন নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে খুবই আগ্রহ, উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখেছি। আমরা ভোটে যে রকম দায়িত্ব পালন করে থাকি, তারাও সে রকম ভোট পরিচালনা করেছে।’
ভাবছিলাম, সব কটি ভোট কেন এ রকম হয় না। তা হলে তো টাকার খেলা হতো না, হিংসায় উন্মত্ত হওয়ার সুযোগ পেত না দুর্বৃত্তরা। হয়তো সৎ, হূদয়বান মানুষ বিজয়ী হতেন। তাঁরা দুর্বল, ন্যায়বিচারপ্রার্থী মানুষের ভরসাস্থল হতেন। শিশুরা যদি এ রকম পারে, বড়রা কেন পারে না! একদিন তো এই বড়রাও অমন সরল শিশু ছিল।
আকমল হোসেন

No comments

Powered by Blogger.