স্থানীয় সরকার-উপজেলা পরিষদের ক্ষমতায়ন সবার আগে by ফয়জুর রহমান ফকির

দুই বছর পাঁচ মাস হলো নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হিসেবে উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা পরিষদ গঠনের ভিত্তি আইনটি অধ্যাদেশ আকারে রচিত হয়েছিল ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।

নির্বাচনটিও সেই আমলেই ঘোষিত হয়েছিল। নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে ভিত্তি আইনটি সংশোধিত হয়ে নির্বাচিত সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং সেই আইনের ভিত্তিতেই উপজেলা পরিষদ পরিচালিত হওয়ার কথা।
সরকার যথার্থ ও আন্তরিকভাবেই উপজেলা পরিষদকে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। আইনের সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি ছাড়া উপজেলা পরিষদ আইন-২০০৯ সেই লক্ষ্যেই প্রণীত। প্রায় দুই বছর আগে জাতীয় সংসদ ওই আইন অনুমোদন করেছে। আইন বাস্তবায়নের জন্য বিধিও জারি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারি কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে যেভাবে কাজ করতেন এখনও প্রায় সেভাবেই চলছেন। অথচ সচিবালয় থেকে ১০ মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়রা, মুখ্য সচিব, সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি নির্দেশ জারি করেছেন ১৩ বিভাগের সব নথিপত্র চেয়ারম্যানদের কাছে উপস্থাপন এবং অনুমোদন গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু সব আদেশ-নির্দেশ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে আমলাতন্ত্রের দ্বারা। চিন্তা করুন কী ভয়ানক অবস্থা। রাষ্ট্রপতির আদেশও সরকারি কর্মকর্তারা কী অবলীলায় লঙ্ঘন করতে পারেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, কে বেশি শক্তিশালী, জাতীয় সংসদ না আমলাতন্ত্র?
উপজেলা পরিষদের আইন জনস্বার্থে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। কোন ১০টি মন্ত্রণালয়ের ১৩টি বিভাগ উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে উপজেলা পরিষদ আইনের তৃতীয় তফসিলে তা উলি্লখিত হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ আইনে অর্থায়নের বিষয়টি অস্পষ্ট ও গোলমেলে। আইন অনুযায়ী ১৩টি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের কার্যাবলি উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত। তাহলে ওই বিভাগের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অংশটুকু কেন উপজেলা পরিষদ তহবিলে হস্তান্তরিত হবে না? জাতীয়ভাবে সব উপজেলার জন্য কিছু আমলা গড়পড়তা একই পরিকল্পনা করেন এবং সেই ভিত্তিক কেন্দ্রীয় বাজেট প্রণীত হয়। তাহলে ১৩টি হস্তান্তরিত বিভাগের কার্যাবলি কি অসার এবং অকার্যকর হয়ে যায় না? পরিষদের কাজ অনেকটা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো হয়ে যায়। তাই বিষয়টি স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন।
হস্তান্তরিত ১৩টি বিভাগের কার্যাবলির পরিকল্পনা ও বাজেট জাতীয়ভাবে কিছু আমলা দ্বারা নির্ধারিত হলে উপজেলা পরিষদ কী নিয়ে পরিকল্পনা ও বাজেট করবে? কোন অর্থায়নের ভিত্তিতে পরিকল্পনা ও বাজেটে হবে? স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, স্থানীয় জনগণের চাহিদা অনুযায়ী ও আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন করবে। অন্যথায় এ ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং এর সুফল জনগণ পেতে পারে না।
তাই পরিকল্পনা এবং বাজেটের প্রয়োজনের ১৩টি বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ উপজেলা পরিষদ তহবিলে হস্তান্তর করতে হবে। কী পদ্ধতিতে তা হস্তান্তরিত বা ব্যয়িত হবে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কয়েকটি পদ্ধতিতে এটি হতে পারে_
১. জাতীয় বাজেটে কী পরিমাণ অর্থ বিভাগ অনুযায়ী একটি উপজেলায় বরাদ্দ হবে, তার আনুমানিক অঙ্ক বাজেট প্রণয়নের আগেই উপজেলা পরিষদকে জানাতে হবে। নিজস্ব রাজস্ব আয়ের অর্থ সংযোজন করে উপজেলা পরিষদ বার্ষিক পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন করবে। জাতীয় সরকার প্রতিটি বিভাগের অর্থ ব্যয়ের জন্য একটি গাইডলাইন দিতে পারে।
২. উপজেলা পরিষদের জন্য বর্তমানে একমাত্র অর্থ বরাদ্দ এডিপির বার্ষিক ৫০-৯০ লাখ টাকা যে প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত হয়, সেভাবেও প্রতিটি বিভাগের জন্য একটি গাইডলাইন অনুসরণ করে ব্যয়িত হতে পারে। তবে পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন করতেই হবে।
আইনে যে ১৩টি বিভাগ উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়েছে তাদের মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলা খুব এলোমেলোভাবে বছরে ৩০ থেকে ৬০ কোটি, অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয়িত হচ্ছে। এ ছাড়াও ওই বিভাগগুলোর বিশেষ বিশেষ প্রকল্প থাকে, যার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, জনগণের কাছে যা অজানা থাকে। হস্তান্তরিত বিভাগ ছাড়াও উপজেলা পরিষদের সদস্য হিসাবে রেগুলাটরি ও রিটেইন্ড বিভাগের মাধ্যমেও কোটি কোটি টাকা ব্যয়িত হয়, যার হিসাবও জনগণ জানে না।
বিগত বছরে উপজেলা পরিষদ কেবল এডিপির ৫০-৯০ লাখ টাকা উন্নয়নের জন্য পেয়েছে। কোনো কোনো উপজেলায় হাটবাজারের ডাক থেকে ৫১ শতাংশ অর্থ উপজেলার উন্নয়ন তহবিলে জমা হয়। এই অর্থে কিছু দায়যুক্ত ব্যয় আছে। ওই ব্যয়ের পর অধিকাংশ উপজেলায় কার্যত কোনো উন্নয়ন জমা থাকে না, অনেক ক্ষেত্রে দায়যুক্ত ব্যয়ে ইউনিয়ন পরিষদের জন্য নির্ধারিত ভূমি হস্তান্তরের ১ শতাংশ অর্থে হাত দিতে হয়। আর রয়েছে উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতর বাসা ভাড়া বাবদ বছরে ১০-১১ লাখ টাকা। এই আয়ও বিআরডিবির সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হয়। এই হচ্ছে উপজেলা পরিষদের বর্তমান অর্থায়ন। এই সামান্য অর্থের ওপর কি উপজেলাকেন্দ্রিক কোনো বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেট হতে পারে? কোনো ধরনের কার্যকর জনসেবা কি সম্ভব?
উপজেলা পরিষদকে অকার্যকর করার একটি আমলাতান্ত্রিক কৌশলের বিষয় উল্লেখ করাটা প্রয়োজন। তাহলো উপজেলা পরিষদ আইনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে কেন্দ্র করে অনেকটা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মতো ১৪টি স্থায়ী কমিটি গঠনের কথা বলা আছে। এগুলো ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইউপি চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে গঠন হওয়ার বিধান রয়েছে। কমিটিগুলো নিজ নিজ বিভাগের কার্যাবলি সম্পর্কে সুপারিশ আকারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং উপজেলা পরিষদের সভায় উত্থাপন করবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। আইনে বলা থাকার পরও মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্রের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউএনওকে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ১০-১৫ সদস্যভিত্তিক কমিটি গঠনের নির্দেশ পাঠানো হয়। এই ১০-১৫ জনের ভেতর এমপি কর্তৃক মনোনীত, ডিসি কর্তৃক মনোনীত এবং ইউএনও কর্তৃক মনোনীত সদস্যরাই থাকেন এবং এভাবে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। উপজেলা পরিষদকে বাইপাস করা হয়, যা কোনো বিবেচনায়ই গণতান্ত্রিক বা আইনসম্মত হতে পারে না।
উপজেলা পরিষদ আইনের ২৫নং ধারাটি গত ২ বছরের উপজেলা পরিষদের কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ৫টি স্তরের ভেতর একমাত্র উপজেলা ব্যতিরেকে অন্য কোনো স্তরে সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা করার বিধান নেই। তাই উপজেলা ব্যতিরেকে অন্য কোনো স্তরে গত দুই থেকে আড়াই বছরে এমপির সঙ্গে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব রচিত হয়নি। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে তাদের পদমর্যাদার কারণে অধিকাংশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা সংসদ সদস্যের উপদেশকে আদেশ এবং সংসদ সদস্যদের একটি বড় অংশ পরামর্শকে টিআর-কাবিখার শেয়ার বোঝান। ফলে মাঠ প্রশাসন বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অচলাবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে। উপদেষ্টার পদটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয় হিসেবে প্রমাণিত।
গণতন্ত্রের ভিত্তিভূমি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে যুগে যুগে দেশে দেশে পরীক্ষিত উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে বর্তমান উপজেলা পরিষদের কার্যাবলির চলমান পরিস্থিতি বদল করে উপজেলা পরিষদ আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
পদক্ষেপগুলো পর্যায়ক্রমে বলা যায় নিম্নোক্তভাবে :
১. উপজেলা আইনের ২৫ এবং তৎসংশ্লিষ্ট ধারাগুলো বাতিল করতে হবে।
২. উপজেলা পরিষদের স্থায়ী কমিটিগুলো কার্যকর করতে মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত ও গঠিত কমিটিগুলো বাতিল করতে হবে। স্থায়ী কমিটিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো কমিটি প্রেরণ বন্ধ করতে হবে।
৩. ১৩টি বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত জাতীয় বাজেটের অংশ উপজেলা পরিষদ তহবিল হস্তান্তর করতে হবে।
৪. ১৩টি বিভাগের সব নথিপত্র (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি, টিএডিএ, অভ্যন্তরীণ বদলি ইত্যাদি) উপজেলা চেয়ারম্যানের অনুমোদন ছাড়া আইনসম্মত ও গ্রহণযোগ্য হবে না বলে বিধি রচনা করতে হবে। পরিপত্র জারি করতে হবে।
৫. অবিলম্বে ভূমি হস্তান্তর করের ১ শতাংশ এবং ভূমি উন্নয়ন করের ২ শতাংশ অর্থ উপজেলা পরিষদ তহবিলে প্রেরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। উপজেলা পরিষদের জন্য ট্যাক্স কাঠামো তৈরি করতে হবে। বিধি ও পরিপত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিতে হবে।
৬. স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য গ্যারান্টি ক্লজের ও মত হস্তান্তরিত সব বিভাগের কর্মকর্তাদের পূর্ণাঙ্গ এসিআর অথবা আংশিক এসিআর উপজেলা চেয়ারম্যানকে লিখতে দিতে হবে। অথবা বর্তমানে আইনে উলি্লখিত এপিআরকে এসিআরের অপরিহার্য অংশ করতে হবে।
৭. উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে সম্মানী ভাতাসহ আর্থিক আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোকে বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের জনগণকে নিয়ে অসংখ্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে উন্নত জীবন ব্যবস্থাসহ অধিকতর গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যেতে পারব বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

ফয়জুর রহমান ফকির : চেয়ারম্যান ময়মনসিংহ সদর উপজেলা, ময়মনসিংহ
 

No comments

Powered by Blogger.